নিখোঁজ পরিবার, লাশ মাড়িয়েই নিরাপদ আস্তানায়

ভয়ের চোটে টানা তিন দিন পাশের বাড়ির দেওয়ালে মুখ গুঁজেছিলেন। জঙ্গিরা যাতে না টের পায়, টুঁ শব্দটিও করেননি তিনি। তার পর সুযোগ বুঝে বাগা থেকে পালিয়ে বর্নোর রাজধানী মাইদুগুরিতেই আশ্রয় নিয়েছেন বছর আটত্রিশের ইয়ানায়ে গ্রেমা। পেশায় মৎস্যজীবী। জঙ্গি হামলায় পুড়ে গিয়েছে বাড়ি, দলছুট পরিবার। কী ভাবে পালিয়ে বাঁচলেন তিনি? সপ্তাহ খানেক পরে সংবাদমাধ্যমকে জানালেন তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

কানো (নাইজেরিয়া) শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৩
Share:

ভয়ের চোটে টানা তিন দিন পাশের বাড়ির দেওয়ালে মুখ গুঁজেছিলেন। জঙ্গিরা যাতে না টের পায়, টুঁ শব্দটিও করেননি তিনি। তার পর সুযোগ বুঝে বাগা থেকে পালিয়ে বর্নোর রাজধানী মাইদুগুরিতেই আশ্রয় নিয়েছেন বছর আটত্রিশের ইয়ানায়ে গ্রেমা। পেশায় মৎস্যজীবী। জঙ্গি হামলায় পুড়ে গিয়েছে বাড়ি, দলছুট পরিবার। কী ভাবে পালিয়ে বাঁচলেন তিনি? সপ্তাহ খানেক পরে সংবাদমাধ্যমকে জানালেন তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা। “রাতের অন্ধকারে ওই পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা যে কী ভাবে পেরিয়েছি, আজ ভাবতেও পারি না। যেখানেই পা দিচ্ছি, সেখানেই লাশ।”

Advertisement

নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহান্তেই বাগার দখল নেয় বোকো হারাম জঙ্গি গোষ্ঠী। কব্জা করে স্থানীয় সেনা শিবিরও। তার পর শুরু হয় গ্রামে-গ্রামে হামলা। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের খবর, বাগা-সহ ১৬টি গ্রাম-শহরে আগুন লাগিয়ে, যথেচ্ছ লুঠপাট চালায় জঙ্গিরা। গত শনিবারের হামলায় ঠিক কত জন নিহত হয়েছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। বাগার জেলা-প্রধান আলহাজি আব্বা হাসান বলেন, “হতাহতের সংখ্যা এখনই বলা সম্ভব নয়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সমীক্ষা প্রয়োজন।” পশ্চিমী কিছু সংবাদমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা বেশ কয়েক গুন বাড়িয়ে বলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

গত শনিবার জঙ্গিরা আগুন লাগায় গ্রেমার বাড়িতেও। তাঁর কথায়, “বিপদের আঁচ পেয়েই জ্ঞানশূন্য হয়ে সব পালাতে শুরু করেন। চলতে থাকে এলোপাথাড়ি গুলি।” গ্রেমা কিন্তু প্রথমেই পালাননি। শহরের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে ভিড়ে পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু পাল্লা ভারী জঙ্গিদের, অস্ত্রশস্ত্রও অনেক আধুনিক। তাই বাধ্য হয়েই পিছু হটতে হয়। গ্রেমা জানান, “আশপাশের ঝোঁপে গিয়ে লুকোতে যান কয়েক জন। জঙ্গিরা সেখানেও গুলি চালায়।”

Advertisement

বাগা শহরে হামলা কিন্তু এ বারই প্রথম নয়। ২০১৩-র এপ্রিলেও একই ভাবে তাণ্ডব চালায় জঙ্গিরা। সে বার নিহত হন প্রায় ২০০ জন। দেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাগার স্থানীয় নিরাপত্তাকর্মীদের জবাব দিতেই বোকো হারামের সাম্প্রতিক এই হামলা।

শনিবার সন্ধে থেকে মঙ্গলবার সন্ধে পর্যন্ত ওই দেওয়ালের আড়ালেই ছিলেন গ্রেমা। মাথার উপর নিমগাছ। তাঁর কথায়, “চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ। ফাটছে পেট্রোল বোমা। দমবন্ধ করে বসেছিলাম, আর মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে দেখছিলাম মানুষ কতখানি নৃশংস হতে পারে।”

রাতের ছবিটা অবশ্য অন্য রকম। গ্রেমার কথায়, “দূরে দেখতাম জেনারেটর জ্বালিয়ে হল্লা করছে জঙ্গিরা। গানবাজনাও শুনতে পেতাম। আর হাসির আওয়াজ।” জঙ্গিদের একটা অংশ বাগার বাজার চত্বরেও ঘাঁটি গেড়েছে বলে দাবি তাঁর। জঙ্গিদের চোখ এড়িয়েই রাতের অন্ধকারে কোনও মতে দু’টো শুকনো খাবার আর জল খেয়েই তিন দিন কাটিয়েছেন তিনি।

বহস্পতিবার মনগুনো থেকে বাসে করে মাইদুগুরিতে পৌঁছন গ্রেমা। এবং আপাতত স্বস্তিতেই। দেশ জুড়ে অশান্তি অবশ্য আজও অব্যাহত। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের দাবি, দেশের উত্তর-পূর্ব অংশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর বাগার দখল নিয়ে বোকো হারাম জঙ্গি গোষ্ঠী এ বার ক্ষমতা বাড়াতে তৎপর। বাগার নিকটবর্তী ডামাতুরু শহরে আজ দিনভর পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াই চলেছে জঙ্গিদের। ইয়োবের রাজধানী শহরেও আজ হামলা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। পাল্টা জবাব দিয়েছে নাইজেরীয় প্রশাসন। হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা না গেলেও সংঘর্ষে বেশ কিছু জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের। ডামাতুরু থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে বোকো হারামের একটি আস্তানায় গত মঙ্গলবার হামলা চালায় স্থানীয় নিরাপত্তাকর্মীরা। এ দিনের জঙ্গি হামলা তারই বদলা বলে মনে করা হচ্ছে।

মাইদুগরির ব্যস্ত বাজারেও আজ একটি বিস্ফোরণের খবর মিলেছে। রেডক্রশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান মোতাবেক, আত্মঘাতী হামলা চালায় এক কিশোরী। বিস্ফোরণে নিহত অন্তত ১০। বেলা বারোটা চল্লিশের ঘটনা। এখনও পর্যন্ত কেউ এই ঘটনার দায় না নিলেও, অভিযোগের আঙুল উঠছে বোকো হারামের দিকেই। কারণ এর আগেও মানববোমা হিসেবে মহিলা বিশেষত কিশোরীদের বহু বার ব্যবহার করেছে এই গোষ্ঠী। বছর দু’য়েক ধরেই দেশ জুড়ে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে বোকো হারাম। স্থানীয় এক মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, শুধু গত বছরেই ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন জঙ্গিহানায়। ঘরছাড়া অন্তত দেড় লাখ।

ফেব্রুয়ারিতেই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাই সাম্প্রতিক এই জঙ্গি হামলা শুধুই এলাকা দখলের লড়াই, নাকি এর পিছনে আরও কোনও গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, তা খতিয়ে দেখছে প্রশাসন। তৎপরতা বাড়ছে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন