ব্যঙ্গের বদলা বুলেট

প্যারিসের পত্রিকায় জঙ্গি হামলা, নিহত ১২

মজা করাই ছিল পত্রিকাটির কাজ। মজা করেই প্রকাশ করা হয়েছিল আইএস-এর নেতা আবু বক্র আল-বাগদাদির ব্যঙ্গচিত্র। টুইট করা সেই ছবিতে লেখা ছিল, “ফ্রান্স এখনও অক্ষত।” আর তার জবাবে ওই জঙ্গি নেতাটি বলছেন, “অপেক্ষা করুন নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত সময় তো হাতে রয়েইছে।”

Advertisement

সোমঋতা ভট্টাচার্য

প্যারিস শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

গুলিতে জখম হয়ে পড়েছিলেন নিরাপত্তাকর্মী। বাঁচতে চেয়ে হাতও তুলেছিলেন। কিন্তু রেহাই মেলেনি। শার্লি এবদো-র দফতরে তাণ্ডব চালিয়ে পালানোর সময় তাঁকে গুলি করে খুন করল জঙ্গিরা। প্রত্যক্ষদর্শীর ক্যামেরায় ধরা পড়ল সেই ছবি। ছবি: রয়টার্স।

মজা করাই ছিল পত্রিকাটির কাজ। মজা করেই প্রকাশ করা হয়েছিল আইএস-এর নেতা আবু বক্র আল-বাগদাদির ব্যঙ্গচিত্র। টুইট করা সেই ছবিতে লেখা ছিল, “ফ্রান্স এখনও অক্ষত।” আর তার জবাবে ওই জঙ্গি নেতাটি বলছেন, “অপেক্ষা করুন নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত সময় তো হাতে রয়েইছে।”

Advertisement

ট্র্যাজেডি প্রহসনে পরিণত হতে দেখা যায় সচরাচর। এ ক্ষেত্রে উল্টোটা হল। টুইট করার একটু পরেই জঙ্গি হামলায় রক্তে ভেসে গেল পত্রিকা অফিস। সন্ত্রাস এ বার থাবা বসালো ছবি আর কবিতার শহর প্যারিসেও।

ফরাসি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বেশ জমজমাট এলাকায় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘শার্লি এবদো’-র দফতর। মূলত রংপেন্সিলে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেই খ্যাত। সেই পত্রিকার অফিসে আজ দিনের আলোয় হঠাৎই ঢুকে পড়ল তিন মুখোশধারী। মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে কালাশনিকভ। এক জনের হাতে আবার রকেট লঞ্চার। কয়েক মুহূর্তে ঝাঁঝরা করে দিল অন্তত ১২ জনকে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক স্তেফান শার্বনেয়ার এবং আরও তিন নামজাদা ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী উয়োলিন্স্কি, তিনু ও কাবু। জঙ্গিদের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে নিহত হন দুই নিরাপত্তাকর্মীও।

Advertisement

তবে এ যে নেহাতই বন্দুকবাজের হানা নয়, পরিকল্পনা মাফিক জঙ্গি-হামলা, তা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। কারণ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) আগেই হুমকি বার্তা পাঠিয়েছিল, এ বার তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ফ্রান্স। তবে তালিকায় তাদের নাম যে শীর্ষে, টের পায়নি শার্লি এবদো।

দুপুর পৌনে একটা নাগাদ মুখোশধারীরা ঝড়ের গতিতে ঢুকে পড়ে ‘শার্লি এবদো’ অফিসের তিনতলায়। সেখানে তখন বৈঠক করছিলেন পত্রিকার সাংবাদিকেরা। স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হাতে তারা ঢুকে পড়ে কনফারেন্স রুমে। আর কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় দশ জনের দেহ। একটি ফরাসি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, শার্লির অফিস থেকে বেরিয়ে আসছেন মাথা ঢাকা পোশাক পরা দু’টি লোক। তার মধ্যে এক জন বেরোনোর পথে খুব কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলল এক জনকে। হাত কাঁপল না। এর পর তারা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল একটা কালো গাড়ির দিকে। মাটিতে এক জোড়া জুতো পড়েছিল। ভাবলেশহীন ভাবে সেটা তুলে নিয়ে দ্রুত এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

পুলিশ সূত্রে খবর, বন্দুকবাজরা প্রথমে প্যারিসের শহরতলির দিকে পালায়। তার পর সেখানে নিজেদের গাড়ি ফেলে রেখে অন্য একটি গাড়ি ছিনতাই করে পালায়। এখনও তাদের নাগাল পায়নি পুলিশ।

আবার অন্য একটি চ্যানেলে দেখা গিয়েছে, জঙ্গিরা চিৎকার করছে “আমরা শার্লি এবদোকে মেরে ফেলেছি। অবশেষে মহম্মদের হয়ে বদলা নিলাম।”

সংবাদপত্রের দফতরে এমন হত্যালীলা দেখে বিশ্ব জুড়েই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সাহিত্যিক সলমন রুশদি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, “আমি শার্লি এবদো-কে সমর্থন করি। ব্যঙ্গ করার অধিকারকে সমর্থন করি। আর সব কিছুর মতো ধর্মকেও সম্মান করার পাশাপাশি সমালোচনা, ব্যঙ্গ করার এক্তিয়ার সবার আছে।” টুইটারে তীব্র ভাষায় নিজের ধিক্কার ব্যক্ত করেছেন তসলিমা নাসরিনও।

স্বাভাবিক ভাবেই আজকের ঘটনার পর এখন চূড়ান্ত সতর্কতায় মুড়ে ফেলা হয়েছে ফ্রান্সকে। ‘শার্লি এবদো’-র কার্যালয়ের সামনে থিকথিক করছে সেনা-পুলিশ, ঘোড়সওয়ার বাহিনী। সরকারি দফতর থেকে সংবাদপত্রের অফিস, দোকান-বাজার, উপাসনাগৃহ কড়া নিরাপত্তা জারি করা হয়েছে দেশের সর্বত্র। ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই বিশ্ববিখ্যাত নতর-দাম গির্জা। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে সেখানেও। ঘটনার পরে তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ। পরে নিরাপত্তা আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকেও বসেন তিনি। ওলাঁদ নিজেই সকলকে সতর্ক করে বলেছেন, “আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরও বেশ কিছু জঙ্গি হামলার হুমকি রয়েছে।” অনেকেই বলছেন, গত দু’দশকে এত বড় মাপের সন্ত্রাসবাদী হামলার সাক্ষী হয়নি ফ্রান্স।

শার্লি এবদো প্রথম সাড়া ফেলেছিল ২০০৬-এ। ডেনমার্কের এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত ইসলামি ধর্মগুরুর একটি ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে তোলপাড় চলছিল তখন। শার্লি এবদো সেই ছবিটাই ফের ছাপে। তবে তখন তাদের দফতরে হামলা হয়নি। আক্রমণের মুখে তারা পড়েছিল আরও পাঁচ বছর পরে। ইতিমধ্যে ওই ওলন্দাজ পত্রিকা থেকেই এসে শার্লির দায়িত্ব নিয়েছেন শার্বনেয়ার। সেটা ২০০৯। ২০১১-তে আবার এক বার ইসলাম নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক প্রচ্ছদ কাহিনি ছাপা হলো। প্রতু্যত্তরে বোমা মেরে আগুন লাগানো হলো শার্লি-র দফতরে। কিন্তু তাদের মনোবলে চিড় ধরেনি তাতে। সম্পাদক শার্বনেয়ার বলেইছিলেন, “ফ্রান্সে আমরা সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারি। তা হলে আমাদের একটা বিষয়ই কেবল বাদ দিতে হবে কেন?”

পরের বছরই কাগজটি আরও কিছু বিতর্কিত ব্যঙ্গচিত্র ছাপে। কিন্তু পত্রিকাটি কোনও দিনই প্রকাশনা সংক্রান্ত আইনি বাধার মুখে পড়েনি, জাতিবিদ্বেষ আইনেও আটকায়নি। শুধু ইসলাম নয়, কখনও ছবির বিষয়বস্তু থেকেছে ভ্যাটিকান, কখনও আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি। এক বার তো একটা ছবিতে রক্তচোষা বাদুড় হিসেবে দেখানো হয়েছিল সারকোজিকে।

কেন বারবার বিতর্কিত বিষয়ে কাজ-কারবার? বছর দুয়েক আগে শার্লির এক ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী লুজ বলেছিলেন, “আমরা সাংবাদিকদের চোখেই খবরকে দেখি। ওঁরা কেউ ক্যামেরা নিয়ে কাজ করেন। কেউ কম্পিউটারে। আমরা কাগজ-পেন্সিলে।” আরও বলেন, “আমাদের কাছে পেন্সিলটা অস্ত্র নয়। শুধু ভাব প্রকাশের মাধ্যম।” সে সময় শার্বনেয়ারও লুজ-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমরা ফ্রান্সে বাস করি। এখানে যথেষ্ট বাক্স্বাধীনতা রয়েছে।”

সেই স্বাধীনতারই মাসুল দিল শার্লি এবদো। শার্বনেয়ার ও তাঁর সহকর্মীরা মত প্রকাশের অধিকার আঁকড়ে থাকতে চেয়ে জঙ্গি-বুলেটে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেলেন। শার্বনেয়াররা বরাবরই বলতেন, “হাঁটু মুড়ে বাঁচার চেয়ে সোজা দাঁড়িয়ে মরা ভাল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন