অফিসের ডেস্কে বসেই ভাইফোঁটার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল! চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।
‘‘মিষ্টি খেতে চাইছি না, অথচ সবাই জোর করে সেই মিষ্টিই খাওয়াচ্ছে! কত বার, কত জনকে না বলা যায় বল তো!’’ বিরক্ত হয়ে বলল বুবি। আমার ভাই। সরকারি ব্যাঙ্কে অফিসার সে। বয়স ৩৬। ইতিমধ্যেই কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বাধিয়ে বসেছে। চালু হয়ে গিয়েছে ওষুধ।
আমাদের বাড়িতে প্রায় সকলেরই হার্টের রোগ। ভাইয়ের কোলেস্টেরল বিপদসীমা পেরোতে তাই পাড়ার ডাক্তারকাকু আর ঝুঁকি নেননি। ওকে বলেছিলেন, ‘‘ওষুধ শুরু করে দে। আর এবার থেকে খাওয়াদাওয়াটা একটু সামলে।’’
মুশকিল হল সামলে নিতে বলা আর সামলানোর মধ্যে যোজন তফাত। উৎসবের মরসুমে নিজেকে সামলে মিষ্টি খাওয়ার অনুরোধ সামলানো, গোলপোস্টের সামনে পেনাল্টি সামলানোর চেয়েও কঠিন। একটু এ দিক থেকে ও দিক হলেই প্লেট থেকে সোজা মুখে। বুবি প্রথমে বিজয়া আর তার পরে অফিসের দীপাবলি উদ্যাপনে দেদার পেনাল্টি খেয়ে অবশেষে ভাইফোঁটার মুখে এসে চিন্তায়। ‘‘দিদি আবার মিষ্টি খাওয়াটা ঠিক হবে না!’’ বলে হতাশ মুখে তাকাল আমার দিকে। কারণ, পরের পেনাল্টি শটের পালা আমার। ভাইফোঁটা আর তার মিষ্টি।
ভাঁজ পড়ল কপালে, তবে ফোঁটায় দেব কি ওকে!
বুবির আগে মোটামুটি ওই একই সুর মিলিয়েছে আমার মামাতো আর জেঠতুতো ভাই। দিন কয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে দেখা তাদের সঙ্গে। মামার ছেলে অয়নকে এসিতে বসেও কুলকুলিয়ে ঘামতে দেখে অবাক হলাম। ভিজে পাঞ্জাবি। মোটা তোয়ালের রুমাল দিয়ে মুছেই চলেছে ঘাড়-মুখ। প্রশ্ন করতে বলল, ‘‘আমার তো হাই প্রেশার। দিনে চারটে করে ওষুধ খাই চার বছর হল। এখন কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডও সব বেড়ে গিয়েছে।’’
অয়নের বয়স ৩১ কি বড়জোর ৩২ হবে। ভাইফোঁটার প্রসঙ্গ উঠতেই ও জানিয়ে দিল, ‘‘এ বার ভাইফোঁটায় কিন্তু আর অত মিষ্টি খেতে পারব না। খাওয়াদাওয়া এখন একটু কন্ট্রোল করছি।’’ ভাবলাম একটু বকাবকিই করব, ‘এত দিন কেন কন্ট্রোল করিসনি’ বলে। তার আগেই শুনলাম পাশ থেকে বড় জ্যাঠার ছেলেও বলছে, ‘‘আরে আমারও একই অবস্থা। সকালে রাতে দু’-বেলা প্রেসারের ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করতে পারছি না!’’
ভাইয়েরা সব হার্টের রোগী। দুধ, চিনি, ক্ষীর, ছানার মিষ্টি তাদের কাছে ‘বিষ’। ছবি: সংগৃহীত।
যা বুঝলাম, ভাইয়েরা সব হার্টের রোগী। দুধ, চিনি, ক্ষীর, ছানার মিষ্টি তাদের কাছে ‘বিষ’। তা হলে এ বার ভাইফোঁটায় ওরা আমার বাড়ি এলে খাওয়াব কী! নানা কথা ভাবতে ভাবতে ফোন করলাম পরিচিত পুষ্টিবিদ শ্রেয়া চক্রবর্তীকে। জানতে চাইলাম, হার্টের নানা সমস্যায় ভোগা ভাইদের জন্য ভাইফোঁটায় স্বাস্থ্যকর কী দেওয়া যায়। শ্রেয়া যে বিকল্পগুলো দিলেন, সেগুলো মন্দ নয়। বললেন, আপেলের ক্ষীর, সুজির হালুয়া, গাজরের পায়েস বানিয়ে দিতে। শুধু বললেন, ‘‘দুধ যেন হয় লো ফ্যাট আর চিনির বদলে দিতে হবে স্টেভিয়া। তেলের জায়গায় অল্প ঘি ব্যবহার করা যেতে পারে।’’ সমস্যা হল, সেই সবই নিজেকে বানাতে হবে, আর আমার হাতে খাবার বানানোর ওই বাড়তি সময়টাই নেই।
পেশাসূত্রে সাংবাদিক। সকালে অফিস রওনা হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ভাইয়েদের জন্য বাড়িতে স্বাস্থ্যকর কোনও রেসিপি শিখে রান্না করব, সেই সময় বা শক্তি— কোনওটিই থাকে না। তাই একটু বাস্তববাদী হয়েই ভাবতে হল। কিছু যদি বদলাতে হয় তবে তা কিনেই আনতে হবে। বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু অনেক ভেবেও শেষ পর্য্ন্ত ড্রাই ফ্রুটস, রোস্টেড মাখানা আর শুকনো খেজুর ছাড়া হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর কোনও খাবারের কথা মনে পড়ল না। কথাটা শুনে বিভাগীয় সম্পাদক সুচন্দ্রা বলল, ‘‘ওই সব খাওয়ালে ভাইয়েরা তোমায় কী বলবে, এখনই আন্দাজ করতে পারছি। পরের বছর থেকে আর ফোঁটা নিতে আসবে না।’’
পুষ্টিবিদ বললেন, লো ফ্যাট দুধে আপেলের পায়েস বানিয়ে দিতে পারো। ছবি: সংগৃহীত।
এই চিন্তা আমারও হচ্ছিল। থালাটা তো দেখতেও সুন্দর হতে হবে! যা হোক রেখে দিলেই তো হল না। কিন্তু বদলে কী দেব? ইদানীং অনেককে দেখি, ভাইকে মিষ্টি খাওয়াবেন না বলে স্যান্ডউইচ, প্যাটিস, বার্গার, হটডগের মতো খাবার কিনে এনে থালায় সাজিয়ে দিচ্ছেন। তাতে মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু যা খাওয়া হচ্ছে, তা-ও তো স্বাস্থ্যকর নয়। বিশেষ করে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা থাকলে চিকিৎসক ফাস্টফুড এড়িয়ে চলতেই বলেন।
অফিসে আমার পাশেই বসে সুদীপা। আতিথেয়তার ব্যাপারে অনেক সময়েই বুদ্ধি দিয়ে উদ্ধার করে। ও বলল, ‘‘তুমি ওদের খেজুর না দিয়ে ‘ডেট বাইটস’ দিতে পারো।’’ নামটা আগে শুনিনি। তবে সুদীপার বর স্বাস্থ্য সচেতন। তাঁর দৌলতে মাঝেমধ্যেই স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু সব অচেনা স্ন্যাকসের গল্প শুনি। সুদীপাই বুঝিয়ে দিল— ‘‘খেজুর আর ড্রাই ফ্রুটস মিলিয়ে এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। চিনি থাকে না। কিন্তু খেতে ভাল। আবার দেখতেও সুন্দর। ওগুলোকে বলে ‘ডেট বাইটস’। অর্ডার করলে এক দিনেই পেয়ে যাবে।’’
চিনি বিহীন ডেট বাইটস। যা তৈরি হয় খেজুর আর ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে। ছবি: সংগৃহীত।
কপালের ভাঁজ কমল বটে। কিন্তু পাতে তো একটা নয়, অন্তত পাঁচটা মিষ্টি সাজিয়ে দিতে হয়। সেই অভাব পূর্ণ হবে কিসে? সুচন্দ্রা বলল, “ভাইফোঁটার সকালে পাঁচটা মিনিট বার করতে পারলে আমার একটা রেসিপি তোমায় দিতে পারি। তবে কয়েকটা ব্যবস্থা একটু আগে থেকে সেরে রাখতে হবে।” ভাইফোঁটার দিনে ভাইয়েদের জন্য পাঁচ মিনিট ব্যয় করা অসম্ভব নয়। রেসিপিটাও দেখলাম বেশ সোজা। শুধু কিছু ফল, দই, ওট্স আর মুজ়লি লাগবে। যা একটু আগে থেকে গুছিয়ে রাখতে হবে।
দই ভাল ভাবে জল ঝরিয়ে ফেটিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। টুকরো করে কেটে রাখতে হবে পছন্দের ফল। পরিবেশনের সময় বাটির নীচে ওট্স বা ওট্স কুকিজ় দিয়ে একটা স্তর তৈরি করে তার উপরে প্রথমে দিতে হবে কলা বা নরম যে কোনও ফলের টুকরো। তার উপরে ফেটানো দইয়ের আস্তরণ দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে পেস্তার গুঁড়ো, বাদামগুঁড়ো বা কুচনো কিশমিশ। পরের স্তরটি হতে পারে, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, কিউয়ি, আপেল জাতীয় কোনও রঙিন ফলের। শেষে আরও এক বার দইয়ের আস্তরণ দিয়ে উপরে বেদানা কিংবা মুজ়লি ছড়িয়ে দিলেই তৈরি স্বাস্থ্যকর মিষ্টি। সুন্দর দেখতে আইসক্রিমের বাটিতে পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলে একাই প্লেটের সব আলো কেড়ে নেবে।
জল ঝরানো দই আর ফলের টুকরো দিয়ে বানিয়ে নেওয়া যায় ফ্রুট ইয়োগার্ট। ছবি: সংগৃহীত।
ভাবতে পারিনি, অফিসের ডেস্কে বসেই এ ভাবে সমস্যার সমাধান হবে। আরও কয়েকটা পরামর্শ পাওয়া গেল। সুদীপা বলল, ‘‘এখন পেরিপেরি বা টম্যাটো ফ্লেভার্ড মাখানা পাওয়া যাচ্ছে, প্লেটে ঢেলে সাজিয়ে দিলে ভালই দেখতে লাগবে। কফি-আমন্ড-পেস্তা-বাদাম দিয়ে তৈরি রেডিমেড চিনি ছাড়া লাড্ডুও দিতে পারো।” চৈতালী মনে করাল ‘অরেঞ্জ ফ্লেভার্ড ডার্ক চকোলেটের’ কথা, যা ওকে কখনও খাইয়েছিলাম। বলল, ডার্ক চকোলেটের একটা বড় টুকরোও তো সাজিয়ে দেওয়া যায় মিষ্টির মতো করে। যায়ই তো! বৃথাই ভেবে ভেবে মাথাখারাপ করছিলাম। ভাইফোঁটার প্লেট তো এর মধ্যেই ভরে গিয়েছে স্বাস্থ্যকর খাবারদাবারে। সুস্মিতাও শুনছিল আমাদের কথা। ও বলল, এর সঙ্গে শেষে শরবতের বদলে একটা গ্রিন টি খাইয়ে দিলে ষোলকলা সম্পূর্ণ...।
ফ্লেভার্ড মাখানা, কফি-বাদামের লাড্ডু, কমলা লেবুর স্বাদের ডার্ক চকোলেটের মতো স্বাস্থ্যকর বিকল্পও রয়েছে বাজারে। ছবি: সংগৃহীত।
আলোচনা শেষ। সমাধানও হাতে। মনে হল, এ বারের ভাইফোঁটা তবে খানিক অন্য রকম হবে। কারণ, ভাইয়ের সামনে খাবারের প্লেটটাই তো দেখতে আলাদা হবে এ বার। কিন্তু উপায়ই বা কি। সময়ের সঙ্গে রোগ ভোগের ধরণ যে ভাবে বদলাচ্ছে। তার সঙ্গে টক্কর দিতে হলে উৎসব পালনের ধারাও তো বদলাতে হবে।