পূর্ব এশিয়ার গুটি কয়েক দেশে কমছে জনসংখ্যা। সেই দেশগুলিতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিয়ে না করার এবং সন্তানের জন্ম না দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গড় জন্মহারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে নবজাতকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে যে সব দেশের, তাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া।
গত কয়েক বছর ধরেই দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটছে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু সে দেশে জনগণের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পরিবার শুরুর প্রতি অনীহা লক্ষ করা গিয়েছে। ফলে অস্বাভাবিক জনসংখ্যাগত বৈপরীত্যের মুখোমুখি হচ্ছে দেশটি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দীর্ঘ সময় কর্মক্ষেত্রে কাটানো, তীব্র পেশাদার চাপ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই প্রেম, ডেটিং, বিয়ে বা সন্তানের জন্ম দেওয়া থেকে মুখ ফিরিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার যুবসমাজ। ফলে সে দেশের জন্মহার অত্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের এ-ও দাবি, দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যার পরিমাণ এতই কমে গিয়েছে যে, কোনও যুদ্ধবিগ্রহ বা পড়শি দেশের বোমার প্রয়োজন পড়বে না। জন্মহার হ্রাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এক দিন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার অস্তিত্বই মুছে যাবে বলে আশঙ্কা তাঁদের।
বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলিতে জন্মের হার কমতে দেখা গিয়েছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চরম সঙ্কটের মুখোমুখি তেমন কেউই নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশটির জন্মহার এতটাই নেমে গিয়েছে যে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা তার বর্তমানের তুলনায় এক তৃতীয়াংশে সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে।
সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ানে’র একটি পুরোনো রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো জনসংখ্যা কমতে শুরু করে ২০২০ সালে। ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষাতেও উঠে এসেছে একটি বিস্ফোরক তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মহিলা বিয়েই করতে চান না। কারণ, বিবাহে অনিচ্ছুক মহিলাদের ৯৩ শতাংশই চান না তাঁদের ঘাড়ে গৃহকর্মের বোঝা এসে পড়ুক। সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব তরুণ-তরুণীদের বিয়ে না করার অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়েছে।
জনসংখ্যা হ্রাসের এই সমস্যার মূলে রয়েছে দেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের তরুণীরা পরিবার পরিকল্পনার চেয়ে নিজের পেশাকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছেন। ২০২৩ সালের একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সন্তান লালনপালনকে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে উল্লেখ করেছেন চাকুরিরতা মহিলারা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় লিঙ্গ বিভাজনও জনসংখ্যা-সঙ্কটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। লিঙ্গবৈষম্যের কারণে সেখানকার অল্পবয়সি পুরুষদের মধ্যে নারীবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পারিবারিক কাজ ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বিশাল ফারাক লক্ষ করা গিয়েছে।
২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মোট প্রজননের হার (এক জন মহিলার প্রজনন বয়সে গড় সন্তানের সংখ্যা) দাঁড়িয়েছে ০.৭২। ২০২২ সালে এই গড় ছিল ০.৮১। দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৮ শতাংশ কমে গিয়েছে। একটি দেশের সুস্থ ও স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য এই গড়ের প্রয়োজনীয় মান হল ২.১। সেই মানের তুলনায় বর্তমান হার অনেকটাই নীচে।
৭০-এর দশকের শুরুতে দেশটিতে নারীদের গড়ে চারটি সন্তান থাকত। ১৯৬০ সালে এই হার ছিল ৬। সেই সময় দেশের অর্থনীতির হাল ধরতে সরকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা শুরু করে। ১৯৮২ সাল নাগাদ অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রজননহার ২.৪-এ স্থির হয়ে যায়।
চলতি বছরের শুরুতে একটি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, যে হারে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে তা খুবই উদ্বেগের। এর ফলে ২১০০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা ৫ কোটি ২ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৭০ লক্ষে এসে দাঁড়াবে।
একই ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় বেড়েছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। গড় আয়ুর উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির কারণে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে, সন্তানধারণে অনিচ্ছার কারণে কমছে পরিবারের সংখ্যাও।
এমন চলতে থাকলে দেশে সামাজিক কাঠামোই নষ্ট হয়ে যাবে, ভেঙে পড়বে অর্থনীতি। এমনটাই আশঙ্কা সে দেশের সরকারের। তাই বিয়ে ও সন্তানধারণের প্রতি যুব সমাজকে আকৃষ্ট করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেছে সে দেশের সরকার।
সরকারি এই প্রকল্পগুলির লক্ষ্য, যুবসমাজকে সম্পর্ক তৈরি, বিয়ে এবং সন্তানধারণের জন্য উৎসাহিত করা। এই উদ্যোগের অধীনে কোনও পুরুষ বা নারী যদি বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে ডেটে যেতে চান, তা হলে তার সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে সরকার।
সরকারের দেওয়া সেই টাকা বাইরে ঘুরতে যেতে, রেস্তরাঁয় খাবার খেতে, সিনেমা দেখতে বা একান্তে সময় কাটাতে ব্যবহার করতে পারেন যুগলেরা। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ডেটে যাওয়ার জন্য যুগলদের প্রায় ৩৫০ ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩১ হাজার টাকা) পর্যন্ত সাহায্য করছে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার।
সরকারি সহায়তা শুধুমাত্র যুগলদের প্রেম বা ডেটে যাওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তাতে থেমে নেই। মজার বিষয় হল, এই প্রক্রিয়া চলাকালীন যদি যুগলের মা-বাবারা দেখা করেন, তবে সেই খরচও আলাদা ভাবে বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জানা গিয়েছে, দক্ষিণ কোরীয় কোনও যুগল যদি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তা হলেও মোটা টাকা আর্থিক সাহায্য দিতে রাজি সরকার। জানা গিয়েছে, বিবাহে ইচ্ছুক যুগলেরা বিয়ে করার জন্য সে দেশের সরকারের কাছ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পেতে পারেন।
সন্তানধারণের জন্যও দম্পতিদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা হয়। সরকারের দাবি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করায়, কোনও দম্পতি যেন সন্তান ধারণ থেকে বিরত না থাকেন, সে কারণেই সেই সিদ্ধান্ত।
সব ছবি: সংগৃহীত।