Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

ভোট টানল বাম-কংগ্রেস, শেষ হাসি সৌগত, মহুয়াদের

সামগ্রিক ভাবে সিপিএম বা কংগ্রেসের ফের পর্যুদস্ত হওয়ার এই বাজারেও রাজ্যে অন্তত এক ডজন আসন পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য অংশের ভোট তাদের প্রার্থীরা। আর তার ফায়দা পেয়ে বিজেপিকে পিছনে ফেলে আসন জিতে নিয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থী।

TMC got dividends as Left-Congress retain a block of votes in many seats, BJP gains too

(বাঁ দিকে) সৌগত রায়, মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪ ১৪:১৮
Share: Save:

আপাতদৃষ্টিতে লোকসভা নির্বাচনে এ বারও রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বিজেপির লড়াই হয়েছে। যেখানে বিজেপি গত বারের চেয়ে ৬টি আসন হারিয়ে নেমে গিয়েছে ১২-য়। আর তৃণমূল আগের চেয়ে ৭টি আসন বাড়িয়ে পৌঁছেছে ২৯-এ। ভোটে বলার মতো প্রভাব ফেলতে পারেনি বাম-কংগ্রেস জোট। কিন্তু ফলাফলের গভীরে গেলে দেখা যাচ্ছে অন্য চিত্র!

সামগ্রিক ভাবে সিপিএম বা কংগ্রেসের ফের পর্যুদস্ত হওয়ার এই বাজারেও রাজ্যে অন্তত এক ডজন আসন পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য অংশের ভোট তাদের প্রার্থীরা। আর তার ফায়দা পেয়ে বিজেপিকে পিছনে ফেলে আসন জিতে নিয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থী। বাম বা কংগ্রেসের পাওয়া ভোটের সুবাদে এবং বিভাজনের অঙ্কে ফের লোকসভায় যাওয়ার সুযোগ যাঁরা পেলেন, সেই তালিকায় আছেন সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া মৈত্র, শতাব্দী রায়ের মতো তৃণমূলের নামী সাংসদেরা। আবার মুর্শিদাবাদ জেলায় শাসক দল যে তিনে তিন আসন ঘরে তুলেছে এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে পরাস্ত হয়ে ফিরতে হয়েছে, তৃণমূলের সেই সাফল্য নিয়েও ‘সংশয়’ তৈরি হত, যদি না তিন আসনেই বিজেপি ভাল রকম ভোট পেত! এর উল্টো ছবিও অবশ্য আছে। তবে তুলনায় কম। রায়গঞ্জ বা বিষ্ণুপুরের মতো আসনে শেষ পর্যন্ত বিজেপি জিতে গিয়েছে কংগ্রেস এবং সিপিএম তাদের বাক্সে উল্লেখযোগ্য ভোট টেনেছে বলে।

তবে আসনভিত্তিক ভোট ভাগাভাগির ঊর্ধ্বে একটা ছবি আবার উঠে এসেছে। রাজ্যে ১৩ বছর সরকার চালানোর পরেও শাসক দল তৃণমূলের ভোটের শতাংশ কমছে না! বরং, সামান্য হলেও এক একটা নির্বাচনে বাড়ছে। তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের মতোই প্রায় এ বারও তারা ভোট পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ক্ষয় সামলে ভোট ধরে রাখার রহস্য কী? দলের নেতা কুণাল ঘোষের মতে, ‘‘উন্নয়ন, বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখা— এই তিনটেই মূল কারণ। যার সমার্থক হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

লোকসভার আসন ধরে ধরে দেখলে অবশ্য বোঝা যায়, ভোট ভাগাভাগির ফায়দা শাসকের ঘরে গিয়েছে। সৌগতের দমদমের কথাই ধরা যাক। তিন বারের সাংসদ এ বার চতুর্থ বার বিজয়ী হয়েছেন ৭০ হাজার ৬৬০ ভোটে। ওই কেন্দ্রে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী দু’লক্ষ ৪০ হাজার ভোট পেয়েছেন। কংগ্রেস সমর্থিত বাম প্রার্থীর এই ভোটের একটা অংশ শীলভদ্র দত্তের (প্রাপ্ত ভোট চার লক্ষ ৫৭ হাজার ৯১৯) দিকে চলে গেলে বিজেপিই আসন জিতে যেতে পারত! পাঁচ বছর আগে রাজ্যে অন্তত ৮টি আসনে সিপিএম নিজেরা কিছু না করতে পারলেও যা ভোট পেয়েছিল, তা তৃণমূল প্রার্থীর জয়ের ব্যবধানের চেয়ে বেশি ছিল। এ বার সেই ঘটনা আরও বেড়েছে। উদাহরণ, দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত সামলে কলকাতা উত্তরে তৃণমূলের সুদীপ বিজেপির তাপস রায়কে হারিয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬০ ভোটে। সেখানে সিপিএমের সমর্থনে কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য এক লক্ষ ১৪ হাজার ৯৮২ ভোট পেয়েছেন। যা আখেরে সুদীপের জয়ে সহায়কই হয়েছে বলে রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যা।

কৃষ্ণনগরের বহুচর্চিত তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া জিতেছেন ৫৬ হাজার ৭০৫ ভোটে। ওই কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী এস এম সাদী টেনে নিয়েছেন এক লক্ষ ৮০ হাজার ভোট। শ্রীরামপুরে সিপিএমের তরুণ মুখে দীপ্সিতা ধর দু’লক্ষ ৩৯ হাজার ভোট পেয়ে দলের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু তৃণমূলের তাতে ‘কল্যাণ’ই হয়েছে! তারা এক লক্ষ ৭৪ হাজার ৮৩০ ভোটে জিতে আসন ধরে রেখেছে। হুগলি থেকে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংসদ হওয়ার নেপথ্যেও একই রকমের অঙ্ক।

বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে বিজেপির দিলীপ ঘোষকে হারিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থী, প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ। দিলীপ হেরেছেন এক লক্ষ ৩৭ হাজার ভোটে। সিপিএমের সুকৃতি ঘোষাল কিন্তু সেখানে এক লক্ষ ৫৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরের দুই সিপিএম প্রার্থী নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত ও শীতল কৈবর্ত্য কার্যত কোনও প্রচারই পাননি সংবাদমাধ্যমে! কিন্তু দুই কেন্দ্রে দু’জনেই এক লক্ষ পাঁচ হাজারের বেশি ভোট টেনেছেন এবং তার জেরে একটিতে তৃণমূল ও অন্যটিতে বিজেপি প্রার্থী জয়ী হয়েছেন!

মুর্শিদাবাদে আবার তৃণমূলের জয়ে পরোক্ষ ভাবে ‘সহায়ক’ হয়েছে বিজেপি। জঙ্গিপুরে কংগ্রেসের মুর্তাজা হোসেন (বকুল) চার লক্ষ ২৭ হাজার, বহরমপুরে কংগ্রেসের অধীর চার লক্ষ ৩৯ হাজার এবং মুর্শিদাবাদে সিপিএমের সেলিম পাঁচ লক্ষ ১৮ হাজার ভোট পেয়েছেন। কিন্তু বিজেপি জঙ্গিপুরে তিন লক্ষ ৪০ হাজার, বহরমপুরে তিন লক্ষ ৭১ হাজার এবং মুর্শিদাবাদে দু’লক্ষ ৯২ হাজার ভোট পেয়েছে। পরিণাম তিন কেন্দ্রেই ফুটেছে ঘাসফুল! অন্য দিকে, রায়গঞ্জে কংগ্রেসের আলি ইমরান রাম্‌জ (ভিক্টর) দু’লক্ষ ৬৩ হাজার ভোট পাওয়ার জেরে শেষ হাসি হেসেছে পদ্ম।

নিজেরা জয় থেকে বহু দূরে থাকলেও ফলাফলে প্রভার ফেলা প্রসঙ্গে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন বলছেন, ‘‘এটা দেশের ভোট। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এবং এনডিএ-কে হারানো এখানে মূল লক্ষ্য ছিল। ভোটের ফলেই বোঝা যাচ্ছে, বাংলায় বিজেপির আসন কমে যাওয়ায় আমাদের ভূমিকা আছে। রাজ্যের সমীকরণ অন্য ভোটে হবে।’’ বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘আমরা তো বারবারই বলেছি, তৃণমূল ও সিপিএমের জোট আছে। দেখা যাচ্ছে, এখানে সিপিএম আমাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলকে জিতিয়েছে।’’ আর তৃণমূলের কুণালের ব্যাখ্যা, ‘‘বহুদলীয় গণতন্ত্রে জিততে না পারলেও অনেক সময় কোনও কোনও দল ভোট পায়, ফলাফল ঘুরে যায়। এটাও সে রকম। রায়গঞ্জ বা বিষ্ণুপুরে তো সিপিএমের জন্য আমরা হেরেছি!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE