Advertisement
১৬ মে ২০২৪
International

‘বলেছিল এই লোকটা ইসলাম বিরোধী, হত্যা করতে হবে’

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর। ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে খুন করা হল। একই দিনে লালমাটিয়ার অফিসে শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুলকে হত্যার চেষ্টা।

গ্রেফতারের পর রাজু।

গ্রেফতারের পর রাজু।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৭:৩৬
Share: Save:

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর। ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে খুন করা হল। একই দিনে লালমাটিয়ার অফিসে শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুলকে হত্যার চেষ্টা। অল্পের জন্য বেঁচে যান টুটুল। দু’জনেই বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের বই-এর প্রকাশক।

সেই হত্যাকান্ডের পিছনে ছিল আনসার-আল-ইসলামের শীর্ষ চার মাসুলের দায়িত্বে থাকা সবুর ওরফে সাদ। সবুরকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২ লাখ টাকা পুরস্কারেরও ঘোষণা ছিল। গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার পাশের টঙ্গি থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ৫ সেপ্টেম্বর রিমান্ডে নেওয়া হয়। গতকাল, ৮ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সবুরকে আদালতে পাঠালে, সে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সেই জবানবন্দির নির্বাচিত অংশ তুলে দেওয়া হল। তার আগে সবুরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

নাম: আব্দুস সবুর ওরফে সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ

যে দলে জড়িত: আনসার আল ইসলাম

বাবার নাম: মওলানা ইদ্রিস পাটোয়ারী

মায়ের নাম: তাহেরা বেগম

বাড়ি: কুমিল্লার লাঙ্গলকোট থানাধীন ঢালুয়া ইউনিয়নের জাপানন্দী এলাকায়

পড়াশোনা

সবুর ছোট বেলায় গ্রামের আইটপাড়া আজিজিয়া কওমী মাদ্রাসায় নুরানি পড়ত। এরপর শিংগিড়িয়া ফয়জুল উলম ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ৩০ পাড়া কোরান হেফজ পড়ে। এরপর নারায়ণগঞ্জ দেওভোগ কওমি মাদ্রাসায় ৪ বছর পড়াশুনা করে। পরবর্তীতে ঢাকার গেণ্ডারিয়া ফরিদাবাদের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। ২০১৩ ও ১৪ সালে সে মিসকাত ও দাওরা পড়া শেষ করে।

কীভাবে সন্ত্রাসের পথে

সবুর ওরফে সাদ আদালতে বলেছে, ২০১৩ সালের শেষের দিকে ফরিদাবাদ মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে আসরের নামাজ শেষে এক ব্যক্তি তার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে। নিজেকে ইসতিয়াক বলে পরিচয় দেয় সে। ইসতিয়াক জানিয়েছিল, সে একটি ফার্মে চাকরি করে। এর ২-৩ সপ্তাহ পর সে আবার ওই মসজিদে আসে। প্রথমে পড়ালেখা ভালভাবে করার উপদেশ দেয়। এর এক-দেড় মাস পর ইসতিয়াক তাকে ব্লু-টুথের মাধ্যমে মোবাইলে কিছু অডিও বয়ান দেয়। এসব বয়ান ছিল জসিমউদ্দিন রাহমানির। এর পর থেকে সবুর কী ভাবে জড়িয়ে পড়ল সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তা ওর বয়ানেই পড়ুন।

জেহাদি হবে?

“কিছু দিন পর ইসতিয়াক আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি বয়ানগুলি শুনেছি কি না। আমি জানাই, হ্যাঁ শুনেছি। ইসতিয়াক আমাকে বলে ইসলামের জন্য জেহাদ করব কিনা। আমি বললাম করব। এর পর ইসতিয়াকের সঙ্গে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হতো। পরে এক দিন ইসতিয়াক আমাকে ফোন দিয়ে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে যেতে বলে। আমি পরদিন দুপুর ১টার দিকে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে যাই। ইসতিয়াক আমাকে নিয়ে কাছেই একটি বাড়িতে যায়। সেখানে আমাকে সেলিম, সাব্বির, আরিফ, সাইফুলদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ইসতিয়াক সবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে। জেহাদের বিষয়ে আলোচনা করে। সেখানে তিন ঘণ্টার মতো ছিলাম। আমাকে প্রটেক্টেড টেক্সট ডটকমে একটি আইডি খুলে দেয়। আইডি নেম ও পাসওয়ার্ড কাগজে লিখে দেয়। আমি ওই আইডির মাধ্যমে চ্যাট করতাম। চ্যাটের মাধ্যমে ইসতিয়াক ও সেলিম যাত্রাবাড়ি এলাকায় দুই রুমের একটি ভাড়া বাড়ি খুঁজতে বলে। দু’দিন খুঁজেও পাইনি। পরে সেলিম বলে যে আর খোঁজার দরকার নেই। বাড়ি পাওয়া গেছে।”

টুটুল দীপন

নতুন আস্তানা, ট্রেনিং, অভিজিতের খুনের সংবাদ

জানুয়ারি (২০১৫) মাসের ১ তারিখে আমাকে যাত্রাবাড়ী যেতে বলা হয়। আমি ১ তারিখে জুম্মার নামাজ শেষে যাত্রাবাড়ী যাই। সাব্বির আমাকে নিয়ে মাহমুদ হাসানের মাদ্রাসার পূব পাশের রসুলপুর এলাকার চার তলা বিল্ডিং-এর তৃতীয় তলায় নিয়ে যায়। সেখানে আমি, সাব্বির, মাসফি, আসাদ তিন মাস ছিলাম। সেখানে আমাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার কৌশল শেখানো হয়। সেলিম চাপাতি ও ৯এমএম পিস্তল বানানো ও চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়। সে ২-৩ দিন পর পর এসে ট্রেনিং দিত। একদিন এশার নামাজের আগে সেলিম বলে ‘একটা কাজ হবে দোয়া করো’।২/৩ ঘণ্টা পর বলে কাজ হয়েছে। পরে শুনি অভিজিৎ (রায়) খুন হয়েছে।”

সন্ত্রাসীদের অলিতে গলিতে

“এটা (অভিজিত্ রায় হত্যাকাণ্ড) ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসের ঘটনা। তিন মাস ট্রেনিং-এর পর আমি ফরিদাবাদ মাদ্রাসার পাশের একটি মেসে উঠি। অন্যরা চলে যায়। ওই মেসে দু’মাস থাকি। এক দিন সেলিম ফোন করে দক্ষিণখান দেওয়ান বাড়ি যেতে বলে। আমি সেখানে গেলে শরিফুল আমাকে নিয়ে দক্ষিণখানের একটি দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। সেখানে সেলিমের সঙ্গে আমি সপ্তাহ খানেক থাকি। এরপর আমাকে আব্দুল্লাহপুর মাস্টারপাড়ায় আরেকটি দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। সেখানে আমি, সিফাত ও শরিফুল তিন মাস থাকি। মাঝে মধ্যে দক্ষিণখানে সেলিম ভাইয়ের বাসায় যেতাম। এর পর টঙ্গির চেরাগ আলি এলাকার আর একটি দোতলা বাড়ির নীচতলায় আমি, সিফাত ও শরিফুল উঠি। ওই বাসার কাছেই টঙ্গির কলেজ গেট বর্ণমালা রোডের চার তলা বিল্ডিংয়ের নীচতলার একটি ঘরে আনসার-আল-ইসলামের মারজান ছিল। শরিফুল সেখানে ট্রেনিং করাতো। শরিফুল বাড়ি গেলে সেলিম আমাকে ট্রেনিং করানোর কথা বলে। আমি তখন আকাশ, আলম, সিহাব, তৈয়ব, রায়হান, রাফিদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। সেলিম ২-৩ দিন পরপর আসতো।

টুটুল ও দীপন হত্যার পরিকল্পনা

“এক মাস ট্রেনিংয়ের পর আমাদের দলকে দু’ভাগ করা হয়। সিফাত, আকাশ, তৈয়ব, আলমকে মহাখালি পাঠানো হয়। পাঠানো হয় প্রকাশক দীপনকে হত্যার জন্য। সিহাব, সাব্বির, তাহসিন, বাবর, ইয়াহিয়াকে এক মাস ট্রেনিং দিয়ে আমাকে প্রধান করে প্রকাশক টুটুল হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেলিম ভাই ও ইসতিয়াক ভাই টুটুলের ছবি দেখিয়ে বলে যে, উনি ইসলামবিরোধী, একে হত্যা করতে হবে। আমার টিম নিয়ে আমি লালমাটিয়া শুদ্ধস্বরের অফিসের এলাকায় দু’দিন গিয়ে রেকি করি। আমি সঠিকভাবে রিপোর্ট দিতে না পারায় আমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে শরিফুলকে দায়িত্ব দেয়। পরে ৩১ অক্টোবর শরিফুল, সিহাব, সাব্বির, বাবর, ইয়াহিয়া, তাহসিনদের নিয়ে সকাল ১০টার দিকে বের হয়ে যায়। শরিফুল অপারেশন শেষ করে টঙ্গির বাসায় ফিরে আসে। একই দিন সিফাতের নেতৃত্বে আলম, আকাশ, তৈয়বসহ আরও দু’জন প্রকাশক দীপনকে হত্যা করে।”

সবুর আদালতে আরও জানিয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মহম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং-এর এক পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় বোমা বানানো, বোমা পাচার ও বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নেয়। এই প্রশিক্ষণ দিত আলি ওরফে নোমান, আইমান ও তানভির। বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকার একটি বাড়ির নীচতলায় চাপাতি-সহ অন্যান্য অস্ত্রের ট্রেনিং-ও নেয় সে। গত সোমবার ঢাকার পাশে টঙ্গি থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

আরও পড়ুন:
দীপন হত্যার মূল অভিযুক্ত সহ ৫ জঙ্গি গ্রেফতার টঙ্গীতে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tutul Dipan Abdus Sabur Raju
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE