জঙ্গিহানার পরে যেন ঘোর কাটছে না কিশোরগঞ্জের। সত্যজিৎ রায় থেকে নীরদ সি চৌধুরীর পারিবারিক এই শহরে জন্ম বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদেরও। বড় কোনও অপরাধে এর আগে নাম না-জড়ানো এই শহর ইদের দুপুরের পর থেকেই শুনশান। উপমহাদেশের সব চেয়ে বড় নমাজের জমায়েতে বুধবার থেকেই লোক সমাগম শুরু হয়েছিল শোলাকিয়ায়। কিন্তু জঙ্গিহানার খবর ছড়িয়ে পড়তেই নমাজিরা দ্রুত শহর ছেড়েছেন। বৃষ্টির মধ্যে সর্বত্র শুধু পুলিশের টহলদারি।
তবে গুলশন ও কিশোরগঞ্জে পর পর দুটি হামলার পরে নিখোঁজ কিশোরদের বিষয়টিই ভাবাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার রাতেও অভিভাকদের কাছে আবেদন করেছেন— ছেলে নিখোঁজ থাকলে পুলিশকে জানান। র্যাবের প্রধান বেনজির আহমেদও বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই বিশেষ দল গঠন করেছেন। নিখোঁজদের সন্ধান শুরু হয়েছে। গত এক বছরে অন্তত ১৩৭ জন কিশোর নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়েছে পুলিশ। তবে লোকলজ্জায় অনেকেই পুলিশকে খবর না-দেওয়ায় প্রকৃত নিখোঁজের সংখ্যা আরও বেশি বলেই তাঁদের ধারণা। এদের একটা বড় অংশ বিত্তশালী পরিবারের।
কিশোরগঞ্জে হামলার জন্য জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) জঙ্গিদেরই দুষছে পুলিশ। দুই হামলাকারীর পরিচয়ও জানা গিয়েছে। এক জন পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও এক জনকে ধরা সম্ভব হয়েছে। তাকে জেরা করে অন্তত ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। ধৃত তরুণ জেএমবি-র প্রথম সারির চাঁই।
পুলিশের গুলিতে হত তরুণ আবির রহমান (১৯) বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। গত শুক্রবার গুলশনের হোলি আর্টিজান বেকারির অন্যতম হামলাকারী নিবরাস ইসলামও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিল। কুমিল্লায় দেবীদ্বার উপজেলা থেকে এসে আবিরের বাবা ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় বাড়ি কিনে বসবাস করতেন। আট মাস নিখোঁজ ছিল আবির। তার বাবা থানায় ডায়েরিও করেছিলেন। নিবরাস ও আবির একই সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনে নাম লিখিয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা। এক সঙ্গে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণও নিয়ে থাকতে পারে। সিসিটিভি-র ফুটেজে আবির ও তার এক সঙ্গীকে পিস্তল হাতে দৌড়তে দেখা গিয়েছে।
ধৃত আর এক জঙ্গি শফিউদ্দিন সোহান জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে সে জেএমবি-তে যোগ দেয়। পুলিশ জানিয়েছে, দিনাজপুরের এই ছাত্র তিন বছর ধরে জেএমবি-র সশস্ত্র শাখার প্রধান হিসেবে কাজ করছিল। তার বাবাও জামাতে ইসলামির নেতা ছিলেন। কয়েক বছর ধরে বাবা-ছেলে দু’জনেই নিপাত্তা ছিলেন। সোহান ধরা পড়ার খবর পাওয়া মাত্র তার মা ও বোনও গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ দিনাজপুরে তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে। সোহানের কাছ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার হয়েছে। পাশের পুকুর থেকে দু’টি চাইনিজ কুড়ুল, একটি চাপাতি ও একটি ব্যাগও উদ্ধার হয়েছে। রা সোহানের পিসতুতো ভাই এনামুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে-ও জেএমবি-র জঙ্গি।
তবে সোহান ও আবিরের সঙ্গে এ দিন আরও ছ’জন হামলাকারী ছিল বলে পুলিশ জেনেছে। কড়া পাহারার মধ্যেও তারা কী ভাবে উধাও হয়ে গেল, তা এখন পুলিশকে ভাবাচ্ছে। এ বিষয়ে আবিরের পোশাক থেকে তারা কিছু সূত্র পেয়েছে। আবিরের শেরোয়ানির মধ্যে জিনসের আরও একটি পোশাক ছিল, যার মধ্যে অস্ত্র লোকানোর একটি পকেট ছিল। পুলিশের ধারণা, বাকি জঙ্গিরাও ওপরের পোশাক ফেলে জিন্সের পোশাকে অস্ত্র লুকিয়ে ভিড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। সোহানকে জেরা করে তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।