—নিজস্ব চিত্র।
মায়ের বুকে উপুড় হয়ে শুয়ে সদ্যোজাত। উষ্ণতার অভাবে কুঁকড়ে থাকা তার ছোট্ট শরীরটা মায়ের ওম পেয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। জন্মের মিনিট কয়েকের মধ্যে স্তন্যপানও শুরু করছে সে।
ওয়ার্মার নয়। হাজারো সরঞ্জামে ঘেরা সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট-ও নয়। জন্মের পরে প্রথম এক ঘণ্টা এ ভাবে স্রেফ মায়ের বুকে থেকেই সুস্থ হচ্ছে কম ওজন নিয়ে জন্মানো অসংখ্য নবজাতক। প্রযুক্তির সহায়তার আশ্বাস তো থাকছেই। তারই পাশাপাশি এ ভাবে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার এই প্রয়াস শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত এই পদ্ধতি রাজ্যে মানা হত না কোনও সময়েই। সম্প্রতি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘হাইপোথার্মিক’ নবজাতকদের বাঁচাতে পরীক্ষামূলক ভাবে এই প্রকল্প শুরু হয়। তাতে ফল মিলেছে ১০০ শতাংশ। ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), ইউনিসেফ এবং দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস)-এর বিশেষজ্ঞেরা এই প্রয়াস দেখে এর ভূয়সী প্রশংসা করে গিয়েছেন। শুধু এনআরএস নয়, রাজ্যের অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে শিশুরা জন্মাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে এখন এই পদ্ধতি মানা শুরু হয়েছে। চিকিৎসকদের ভাষায়, ‘মায়ে-ছায়ে গায়ে-গায়ে’!
রাজ্যে প্রসূতি ও শিশু-মৃত্যুর হার কমাতে গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক ভাবে এই পদ্ধতি স্বীকৃত। কিন্তু অজ্ঞতা ও উৎসাহের অভাবে আমরা মানতাম না। এনআরএস পথ দেখাল। রাজ্যের বেশির ভাগ মেডিক্যাল কলেজেই এটা মানার চেষ্টা চলছে। অপেক্ষাকৃত কম ওজন নিয়ে জন্মানো বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি মানা হচ্ছে এই পদ্ধতি। হাতেনাতে ফল পাচ্ছি আমরা।’’
সন্তানের জন্মের পরে তড়িঘড়ি তাকে নার্সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া যে একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়, চিকিৎসকেরা অনেকেই তা বারবার বলে আসছেন। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালেই তা মানা হয় না। সরকারি হাসপাতালেও অনেক সময়ে প্রসবের বহুক্ষণ পরে সন্তানকে কাছে পান মা। আর শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মালে তাকে তড়িঘড়ি পঠিয়ে দেওয়া হয় সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিটে (এসএনসিইউ)। এতে বহু সময়েই দেখা যায়, জন্মের পরে শিশুর শরীরের যে তাপমাত্রা থাকে, এসএনসিইউ-এ পৌঁছে তা আরও কমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাপমাত্রা অতিরিক্ত নেমে ‘হাইপোথার্মিয়া’ হয়ে যায়। এ রাজ্যে এখনও নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটাই। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে চিকিৎসকেরা দেখলেন, প্রসবের পরে সন্তানকে মিনিটখানেক মায়ের কাছে রেখেই পাঠানো হচ্ছে এসএনসিইউ-তে। ভাল ভাবে সদ্যোজাতকে না ঢেকেই বেশ খানিকটা পথ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে শিশুর অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে।
এর পরিবর্তে পরীক্ষামূলক ভাবে শিশুর জন্মের ঠিক পরেই তাকে মায়ের বুকে রাখা শুরু করলেন তাঁরা। দু’এক মিনিট নয়, টানা এক ঘণ্টা। আর তাতেই ‘মির্যাকল’! দেড় কিলোগ্রাম থেকে এক কিলো ৮০০ গ্রাম ওজনের মধ্যে জন্মানো যে শিশুরা আকছার হাইপোথার্মিয়ার শিকার হত, তারা আর তা হচ্ছে না।
এনআরএসের এসএনসিইউ-এর ইনচার্জ অসীম মল্লিক বলেন, ‘‘প্রসবের ঠিক আগেই আমরা দু’টি তোয়ালে গরম করে রাখছি। প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে একটি তোয়ালেতে বাচ্চাটিকে মুড়ে মায়ের বুকে রাখা হচ্ছে। ওই তোয়ালেতেই তাকে পরিষ্কার করে তোয়ালেটি ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তার পরে অন্য তোয়ালে জড়িয়ে মায়ের বুকে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হচ্ছে। এক মিনিট পরে কাটা হচ্ছে আম্বেলিকাল কর্ড।’’ তিনি জানান, এক মিনিটের আগে কর্ড কাটা ঠিক নয়। কারণ ওই কর্ড ব্লাড থেকে যে হিমোগ্লোবিন শিশুর শরীরে পৌঁছয়, তা পরবর্তী সময়ে শিশুকে অ্যানিমিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
তবে শিশু যদি জন্মের পরে না কাঁদে বা শ্বাসকষ্ট নিয়ে জন্মায়, সে ক্ষেত্রে কর্ড কাটার পরেই তাকে এসএনসিইউ-য়ে পাঠানোর উপরে জোর দিয়েছেন তাঁরা। সেখানে অবস্থা স্থিতিশীল হলে তার পরে সদ্যোজাতকে মায়ের বুকে রাখতে হবে। চিকিৎসকেরা জানান, শুধু স্বাভাবিক প্রসব নয়, ভবিষ্যতে সিজারিয়ান প্রক্রিয়ায় জন্মানো শিশুর ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিই চালু করতে চলেছেন তাঁরা।
অসীমবাবুর কথায়, ‘‘কোনও বাড়তি টাকা খরচ হবে না। বাড়তি কর্মীও দরকার নেই। যা দরকার তা হল— বিষয়টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা আর সদিচ্ছা। জেলায় জেলায় ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে হবে। এই পদ্ধতি পুরোদমে চালু হলে সদ্যোজাতের এসএনসিইউ-য়ে থাকার মেয়াদ কমবে। ফলে এসএনসিইউ-এর উপরে চাপও কমানো যাবে।’’
তবে এ নিয়ে প্রশ্ন যে একেবারে ওঠেনি, তা নয়। অনেকেই বলেছিলেন, মায়ের বুকের উপরে শিশুকে রাখলে পাশে কোনও এক জনকে সব সময়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তা না হলে শিশুর পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে। এমনিতেই নার্সের সংখ্যা কম। তা হলে পাশে থাকবেন কে?’’ এনআরএসের স্ত্রী-রোগ বিভাগের চিকিৎসক রুণা বল বলেন, ‘‘প্রসূতির সঙ্গে তো বাড়ির কেউ না কেউ থাকেনই। নার্স না থাকলে শয্যার পাশে বাড়ির লোককেও রাখা যায়।’’
এই প্রকল্পে উচ্ছ্বসিত এইমস-এর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অশোক দেওরারি। তিনি জানান, এইমস-এও তাঁরা এই প্রকল্পকে উৎসাহ দিচ্ছেন। কারণ, ‘‘এতে বাচ্চার দেহের তাপমাত্রা বাড়ে, জন্মের পর থেকেই স্তন্যপান শুরু হয়, এমনকী মায়ের রক্তক্ষরণও কমে। মা ও শিশু উভয়ের ‘স্ট্রেস লেভেল’-ও কমে যায়।’’
মায়ের বুকের কাছে সন্তানকে জড়িয়ে রাখার ব্যবস্থাকে সাধারণ ভাবে ‘ক্যাঙারু কেয়ার’ বলে। এতে মা ও সন্তানের মধ্যে শুরু থেকেই গভীর বন্ধনও তৈরি হয় বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। জন্মের পরে প্রথম এক ঘণ্টা বুকে রাখার এই ব্যবস্থা সেই ক্যাঙারু কেয়ার-এরই আরও উত্তরণ ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘সন্তানকে প্রথমেই বুকে পেলে মায়ের বুকের দুধ ক্ষরণও বেশি হয়। ভবিষ্যতে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের ভয়ও অনেক কমে। প্রকৃতি আমাদের যা শিখিয়ে দিয়েছে, তা মেনে চললে আখেরে যে ফলটা ভালই হয়— তা আরও এক বার প্রমাণিত হল।’’
আরও পড়ুন: যমজ সন্তানকে স্তন্যপান করাতে করাতেও থেমে নেই অফিসের কাজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy