এখনও বিহ্বল। সোমবার কৌশিক সরকারের তোলা ছবি
রেড রোডে বায়ুসেনা জওয়ান অভিমন্যু গৌড়ের মৃত্যু নিয়ে চাঞ্চল্যের মধ্যেই কলকাতা প্রমাণ দিল, এ শহরে সাম্বিয়াদের সংখ্যা কম নয়। তাদের পাশাপাশি় টিমটিম করে কিছুটা মনুষ্যত্বও অবশ্য টিকে রয়েছে। রবিবার সেটাও প্রমাণ করলেন অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী।
ঘটনার সূত্রপাত রবিবার রাত এগারোটায়। নদিয়ার চাকদহতে অভিনেতা দেব-এর সঙ্গে একটা শো করে এক সহকারী এবং দুই বাউন্সারকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা ফিরছিলেন মিমি। তেঘরিয়ায় এসে তাঁরা দেখেন, একটি ইন্ডিকা গাড়ি এক বাইক-আরোহীকে ধাক্কা মেরে পালাচ্ছে। চাকায় আটকে যাওয়া মানুষটিকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে লেক টাউনের ‘বিগ বেন’ অবধি টেনে নিয়ে চলল গাড়িটা।
চোখের সামনে এ রকম একটা দৃশ্য দেখে মিমির তখন রাগে-আতঙ্কে সারা শরীর কাঁপছে। লেক টাউনের কাছে ইন্ডিকার গতি একটু কমতেই মিমিরা গাড়িটাকে ধরে ফেলেন। মিমি নিজে রাস্তায় নেমে গাড়ির নম্বরপ্লেট এবং মদ্যপ দুই আরোহীর ছবি তুলে নেন মোবাইলে। মিমির দুই বাউন্সার ইন্ডিকার চাবিটা বার করে নেন। মিমি ফোন করেন তাঁর বন্ধু পরিচালক রাজ চক্রবর্তীকে। ফোন করা হয় মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। খবর যায়, বাগুইহাটি আর লেকটাউন থানাতেও।
পুলিশই পরে জানায়, আহত ব্যবসায়ীর নাম রাকেশ অগ্রবাল। বাড়ি তেঘরিয়াতেই। আশঙ্কাজনক অবস্থা তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি। ধৃত দুই মদ্যপ আরোহীর নাম রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় ও ব্রজ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সোমবার সকালে ঘটনাটা বলার সময়ও মিমির গলা থরথর করে কাঁপছিল। বারবার বললেন, রাকেশবাবুর কোনও দোষ ছিল না। ওঁর মাথায় হেলমেট ছিল। ভিআইপি রোডের বাঁ দিক ঘেঁষে আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলেন তিনি। মত্ত ইন্ডিকাই আচমকা তাঁকে ধাক্কা দেয়। রাকেশবাবু টাল সামলাতে না পেরে গাড়ির নীচে চলে আসেন।
পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। মিমি বলে চলেন, ‘‘রাকেশবাবু যখন চাকার তলায় এসে পড়লেন, তখনও যদি ওরা গাড়িটা থামাত, মানুষটা অতটা জখম হতেন না।’’ কিন্তু রাকেশবাবু চাকায় আটকে গিয়েছেন— এই অবস্থাতেই তাঁকে নিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে যায় ইন্ডিকা। শিউরে উঠে মিমি বলেন, ‘‘হঠাৎ দেখলাম মানুষটার পা-টা দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেল। আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। আমার ড্রাইভারকে বললাম, ওদের কিছুতেই পালাতে দেব না।’’
‘গানের ওপারে’ ধারাবাহিকে পুপে-র ভূমিকায় যাঁর কেরিয়ার শুরু, সেই মিমি এমনিতেই টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে ডাকাবুকো বলে পরিচিত। পর্দাতেও বেশ কড়া ধাতের চরিত্র করে থাকেন। ছোটবেলায় জলপাইগুড়িতে থাকাকালীন নিয়মিত অ্যাথলেটিক্সের চর্চা করতেন। লেক গার্ডেন্সে এক বার দুই মাদকাসক্তকে মেরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রবিবার রাতেও লেক টাউন আসতেই স্করপিও থেকে নেমে পড়েন তিনি। ইন্ডিকার দুই মদ্যপ তখন কাকুতিমিনতি করছে, ‘‘ক্ষমা করে দিন। একটু ভুল হয়ে গিয়েছে!’’ স্তম্ভিত মিমি পরে বলেন, ‘‘কথাটা শুনে চমকে গিয়েছিলাম। মানুষ খুন করাটা ‘একটু ভুল’ হল?’’
এর মধ্যেই লেক গার্ডেন্স থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান রাজ চক্রবর্তী। চলে আসে পুলিশ। রাকেশের স্ত্রীকে ফোন করে খবর দেন মিমি নিজে। সোমবার রেশমি অগ্রবাল হাসপাতাল থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘‘আমি সত্যি বুঝতে পারিনি উনি মিমি চক্রবর্তী। ওঁর জন্যই দোষীরা ধরা পড়ল। আজকাল কেউ এ ভাবে অচেনা মানুষকে সাহায্য করে না!’’
মিমির অভিনীত ছবি ‘বোঝে না সে বোঝে না’ এবং ‘খাদ’-এ কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুই ছিল দু’টি বাস দুর্ঘটনা। কিন্তু শহরের রাস্তায় চর্মচক্ষে এমন বীভৎসতার সাক্ষী হতে হবে, সেটা নায়িকার জানা ছিল না। মিমি এখনও আতঙ্কের ঘোরে রয়েছেন। ঘুমের ওষুধ খেতে হচ্ছে তাঁকে।
সান্ত্বনা একটাই। দোষীরা পালাতে পারেনি। কিন্তু একই সঙ্গে শহর কলকাতার অদ্ভুত উদাসীনতাও মিমিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তাঁর ক্ষুব্ধ আক্ষেপ, ‘‘তিন কিলোমিটার রাস্তা যখন মানুষটা ঘষটে ঘষটে যাচ্ছিল, একটা গাড়িও থামল না। যখন আমরা গাড়িটাকে আটকালাম, তখনও কেউ দাঁড়াল না। যারা আশেপাশে ছিল, তারা এসে আমার ছবি তুলতে লাগল, কেউ আহত মানুষটার দিকে ফিরে তাকাল না।’’
উন্মত্ত গাড়ি আর নির্লিপ্ত নাগরিকের মাঝখানে মিমির মতো বিরল মুখই শহরবাসীর সান্ত্বনা। বিশেষত এ দেশে যেখানে গাড়ি চাপা দেওয়ার মামলায় বারবার কেষ্টবিষ্টুদের নাম জড়ায়, তাঁরা পারও পেয়ে যান এবং সেই তালিকায় চিত্রতারকারাও বাদ যান না। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পর্দা আর পর্দার বাইরে, দু’জায়গাতেই মিমি খুব স্পষ্টবাদী। ছোট শহরে বড় হওয়ার দরুণ এই গুণটা পেয়েছে ও। তাবড় নায়করা যা করতে পারেন না, মিমি কিন্তু সেটাই করে দেখাল। যথার্থ নায়িকার মতো।’’
(সহ প্রতিবেদন: প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy