Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

টাকি পুরসভার ভাড়া বাড়ি সারাতে খরচ হয় ৭০ টাকা

সে বার বাঘ ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। হইহই রইরই কাণ্ড। লোকজন ভয়ে ঘর থেকে বেরনোই কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিল। দিনেদুপুরেও লাঠিসোঁটা, দা-কাটারি হাতে বেরোত গাঁয়ের লোক। বাঘের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ টাকি টাউন কমিটি শেষমেশ বাঘ মারতে পুরস্কার ঘোষণা করে। যার নগদ মূল্য ছিল ১৬ টাকা!

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০১:৩১
Share: Save:

সে বার বাঘ ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। হইহই রইরই কাণ্ড। লোকজন ভয়ে ঘর থেকে বেরনোই কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিল। দিনেদুপুরেও লাঠিসোঁটা, দা-কাটারি হাতে বেরোত গাঁয়ের লোক। বাঘের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ টাকি টাউন কমিটি শেষমেশ বাঘ মারতে পুরস্কার ঘোষণা করে। যার নগদ মূল্য ছিল ১৬ টাকা!

নগদ বিদায় কার কপালে জুটেছিল, সেই ইতিহাস অবশ্য ধুলোয় ঢেকেছে। নয় নয় করে বয়স তো কম হল না টাকির। ইছামতী নদীর এক প্রান্তে টাকি। অন্য প্রান্তে বাংলাদেশের সাতক্ষিরা। ফি-বছর দুর্গাপুজোর ভাসানের দিনে এই নদীতে দুই বাংলার মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। রাজ্যে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ টাকিতে ইছামতীর পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় গেস্ট হাউস, ওয়াচ টাওয়ার, পার্ক, মিনি সুন্দরবন। বাইনোকুলার কিম্বা নাইটভিশন ক্যামেরায় চোখ রেখে সর্ব ক্ষণ চলছে সীমান্তরক্ষীদের কড়া নজরদারি। হাতে এলএমজি কিংবা কারবাইন নিয়ে বিএসএফ জওয়ানদের টহলদারিও চলছে। নদীর অন্য পাড়ে সাতক্ষিরার শ্রীপুর, ভাতসালা, দেভাটা গ্রামে সবুজের সমারোহ দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায় এ পাড়ে বসেও। এমন নানা শোভা নিয়েই সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশদ্বার টাকি।

টাকির টুকিটাকি। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল ৪টি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি হয় টাকি পুরসভা। ১৪ জন মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল টাউন কমিটি। শুরুতে পুরসভার কাজ চলত মোহিত কুণ্ডুর বাড়িতে। টাকি পুরসভার প্রথম ভারপ্রাপ্ত পুরপ্রধান সতীকান্ত মুখোপাধ্যায় এবং উপপ্রধান হয়েছিলেন জ্ঞানেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী। ওই সময়ে টাকির বেশির ভাগ জায়গা ছিল জঙ্গলে ভরা। টাকি, সৈয়দপুর এবং জালালপুরে জমিদার বাড়ি ছিল টাকির পুরএলাকার মধ্যেই। সাড়ে ৪ বর্গ মাইল এলাকায় লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৫২৪৫ জন।

টাকির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৮৮১ সালে পুরসভা একটি বাড়ি ভাড়া নেয়। পুরনো বাড়িটি মেরামতির জন্য খরচ হয়েছিল ৭০ টাকা। রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী টাকিতে বসতি স্থাপন করেন। আজকের ইছামতী নদীর সে সময়ে নাম ছিল যমুনা-ইছামতী। কৃষ্ণদাসের চেষ্টায় টাকি সম্ভ্রান্ত এবং ব্রাহ্মণ পরিবারের বাসভূমিতে পরিণত হয়। নন্দদুলালের বিগ্রহ স্থাপনের জন্য টাকিতে জালালপুর গ্রামের বেশ নামডাক ছিল। রাজা মানসিংহ সে বার প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যে আক্রমণ শানানোর জন্য টাকিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দু’পক্ষের লড়াই হয় বসিরহাটের সংগ্রামপুরে। প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে তাড়া করে মানসিংহের বাহিনী। টাকি শ্মশানের পাশ দিয়ে যমুনা-ইছামতী পার হয়ে রক্ষা পায় প্রতাপাদিত্যের দলবল। সেই ইতিহাসকে মনে রেখেই শ্মশান-সংলগ্ন রাস্তার নাম পরে রাখা হয় মানসিংহ রোড। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে টাকি কুলেশ্বরী কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা হয়।

টাকির কাছেই ইছামতী নদীর তীরে সোলাদানার বাগুন্ডিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবণ ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছিল। ১৮২২ সালে সেখানকার সেরেস্তাদার (নিমকি দেওয়ান) হয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। কলকাতার বরাহনগর ঘাট থেকে ইছামতী নদীপথে বাগুন্ডিতে ব্যবসার কাজে এলে দ্বারকানাথকে সাজানো বজরায় করে বাড়িতে নিয়ে যেতেন টাকির জমিদার মুন্সি কালীনাথ রায়চৌধুরী। অনেক পদস্থ ব্রিটিশ কর্তারাও তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করতেন। কালীনাথের বাড়িতে দুর্গাপুজো, কালীপুজো হত। নাটক, নাচ-গানের আসরও বসত। আর ছিল যাত্রাপালা। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান কালীনাথ। তিনি কিছু গান রচনা করেছিলেন। ভারতচন্দ্রের বই পার্সি ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন এই মানুষটি। কালীনাথের উদ্যোগেই সোলাদানা থেকে বারাসাত পর্যন্ত ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রায় দশ বছর ধরে রাস্তা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তিতে রাস্তাটির নামকরণ হয় টাকি রোড।

রাজা রামমোহনের পরামর্শে এবং খ্রিস্টান মিশনারি আলেকজান্ডার ডকের পরিচালনায় জমিদার কালীনাথ ১৮৩২ সালের ১৪ জুন টাকিতে একটি ইরাংজি মাধ্যম স্কুল স্থাপন করেন। তাঁর চেষ্টায় টাকিতে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটে। ১৮৫১ সালে টাকি স্কুল (বর্তমানে টাকি সরকারি বিদ্যালয়) স্থাপিত হয়। ১৮৬২ সালে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন হয়।

১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্টিন কোম্পানির ট্রেন ছুটতে শুরু করে বারাসাত-বসিরহাট লাইনে। ১৯০৯ সালে সেই লাইন চিংড়িহাটা (হাসনাবাদ) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ১৮৯৬ সালে বারাসাত-বসিরহাটের মধ্যে ন্যারো গেজ রেল লাইন চালু হয়। ১৯৫৫ সালের ১ জুলাই মার্টিন রেল বন্ধ হয়ে যায়। দেশভাগের আগে এই রেলপথই ছিল মানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পরিবহণের মাধ্যম। পরে জনগণের প্রবল বিক্ষোভের জেরে ২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৭৪ কিলোমিটার ব্রড গেজ লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯৬২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বারাসাত-হাসনাবাদ প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালু হয়। ১৯৮৩ সালের ১৩ মে হাসনাবাদ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৮৬৫ সালে তারাশঙ্কর দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা হয় টাকিতে। ১৯৩৭ সালের ১৭ এপ্রিল অজিতনাথ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত টাকি হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একেএম ফজলুল হক।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE