Advertisement
E-Paper

এ পারে আক্রান্ত ছিন্নমূল পরিবার

একটু নিরাপত্তার আশায় জন্মভূমি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারটি। বোঝেননি, এ পারেও অত্যাচারের শিকার হতে হবে তাঁদের কিশোরী মেয়েকে। চার মদ্যপ যুবকের হাতে যৌন নির্যাতনের জেরে মেয়েকে সংজ্ঞাহীন হতে দেখলেন অসহায় বাবা-মা।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০১:০৪

একটু নিরাপত্তার আশায় জন্মভূমি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারটি। বোঝেননি, এ পারেও অত্যাচারের শিকার হতে হবে তাঁদের কিশোরী মেয়েকে। চার মদ্যপ যুবকের হাতে যৌন নির্যাতনের জেরে মেয়েকে সংজ্ঞাহীন হতে দেখলেন অসহায় বাবা-মা। এর প্রতিকার করতে ভরা বাজারে সালিশি সভা বসল। জরিমানাও করা হল চার অভিযুক্তকে। কিন্তু তার পরও অভিযুক্তদের পরিবার এবং গ্রামবাসীদের একাংশের হুমকি চলছেই। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে ছিন্নমূল পরিবারটি। এই পরিস্থিতিতে কিশোরীর মায়ের প্রশ্ন, “কোথায় গেলে নিরাপত্তা পাব বলতে পারেন?”

সালিশি সভায় উপস্থিত ছিলেন নানা দলের নেতারা। মামজোয়ান গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল সদস্য শুভেন্দু সরকার উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন। বাজার কমিটির সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা সুভাষ হালদার, কংগ্রেস নেতা সুহাস বন্দ্যোপাধ্যায় সালিশিতে থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ছিন্নমূল পরিবারটির বৈধ নাগরিকত্ব না থাকায় পুলিশের কাছে গেলে বিপদে পড়তে পারে বলেই তাঁরা সালিশি করে বিষয়টি মেটাতে চেয়েছিলেন। তবে জরিমানার সিদ্ধান্ত তাঁদের নয়, দাবি করছেন ওই নেতারা। মামজোয়ান গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের একেবারে শেষ সীমানায় বাড়ি ওই হিন্দু পরিবারের। কিশোরীর মা জানান, হোলির দিন দুপুরে হঠাত্‌ বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে গ্রামেরই চার মদ্যপ যুবক। প্রথমে তারা কিশোরীর মাকে জোর করে রং মাখায়। বিপদ বুঝতে পেরে কিশোরী ঘরের ভিতরে ঢুকতে গেলে ওই যুবকরা তাকে জোর করে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মেয়ের বিপদ বুঝতে পেরে বাধা দিতে গেলে মারধর করা হয় কিশোরীর বাবা-মাকে। প্রায় মিনিট পনেরো এ ভাবেই চলে অত্যাচার, দাবি ওই কিশোরী ও তার পরিবারের।

তাদের চেঁচামেচিতে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। তাঁদের দেখে বেরিয়ে আসে অভিযুক্তরা। মদ্যপ চার যুবকের এক জন রামদা নিয়ে কিশোরীর পরিবারের লোকদের তাড়া করে। ভয়ে তাঁরা বাড়ির পিছনের মাঠ দিয়ে ছুটে পাশের পীরপুর গ্রামে হাজির হন। সেখানে যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যায় ওই কিশোরী। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামীণ চিকিত্‌সকের কাছে। তিনি তাকে বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। বগুলার হাসপাতাল থেকে ফের শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিত্‌সার পরে তাকে বৃহস্পতিবার রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। যদিও সে পুরোপুরি সুস্থ নয়।

শুক্রবার দুপুরে শুরু হয় হুমকি। কিশোরীর পরিবার যাতে পুলিশের কাছে অভিযোগ না করে, তার জন্য ক্রমশ চাপ দেওয়া হতে থাকে। তবু ওই কিশোরীর বাবা মামজোয়ান বাজারে গিয়ে ঘনিষ্ঠদের কাছে বিষয়টি জানান। সেখানে কোনও ভরসা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওই পরিবার। সেই মতো শনিবার সকালে হাঁসখালি থানায় যাওয়ার জন্য বের হন কিশোরী ও তার মা। কিন্তু অভিযুক্ত যুবকদের পরিবার এসে বাধা দেয়। অভিযুক্তরাই বাজারের লোকজনের কাছে আবেদন করেন, বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে দেওয়ার। বাজারের পাশেই একটা আমবাগানে ওই কিশোরীর পরিবার ও অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সালিশি সভা বসে।

সালিশি সভায় নিদান দেওয়া হয়, টাকা নিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে হবে কিশোরীর পরিবারকে। থানায় নালিশ করা চলবে না। কিছু দরাদরির পর ঠিক হয়, চার অভিযুক্তের পরিবার দেড় লক্ষ টাকা দেবে। তখনই ৬০ হাজার টাকা অভিযুক্তদের কাছ থেকে নিয়ে তা রেখে দেওয়া হয় গ্রামেরই এক ব্যক্তির কাছে। বাকি টাকা ১৭ মার্চের মধ্যে মেটাতে বলা হয়।

তখনকার মতো এই ফয়সালা হলেও, রবিবার চার অভিযুক্ত যুবকের এক জন বাড়িতে কীটনাশক খায়। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে সোমবার সকালে তার মৃত্যু হয়। কিশোরীর পরিবারের দাবি, তার পরেই কিশোরীর পরিবারকে দায়ী করে ফের হুমকি দিতে শুরু করে অভিযুক্তরা। মৃত যুবকের বাবার অভিযোগ, মিথ্যা অপবাদ এবং টাকার জন্য চাপ সহ্য করতে না পেরেই তাদের ছেলে আত্মহত্যা করেছে।

সালিশি সভায় উপস্থিত মাতব্বররা অবশ্য দাবি করছেন, অভিযুক্তরাই টাকা দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। মামজোয়ান গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য শুভেন্দুবাবু বলেন, “আমি কাউকে টাকা দেওয়ার কথা বলিনি। ওরা নিজেরাই আলোচনা করে ঠিক করেছিল।’’ মামজোয়ান বাজার কমিটির সভাপতি সুভাষবাবু বলেন, “ওরাই আমাদের কাছে এসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার কথা বলেছিল। টাকার কথা ওরা নিজেরাই ঠিক করেছিল।” তাঁর দাবি, গ্রামগঞ্জে এমন অনেক “ছেটোখাট” ঘটনা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মিটিয়ে দেওয়া হয়। একই কথা বলেন সালিশি সভায় উপস্থিত কংগ্রেস নেতা সুহাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “আমরা চেয়েছিলাম যে মেয়েটা যেন সুবিচার পায়। ওরা বাংলাদেশী। বিষয়টি প্রশাসনের কাছে গেলে ওরাও বিপদে পড়ে যেতে পারত।” তাঁর দাবি, মৃত যুবকটি অনুশোচনায় আত্মঘাতী হয়েছে, টাকার চাপের জন্য নয়।

তবে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় সালিশি সভার মাতব্বররা এখন দূরত্ব তৈরি করছেন। তাঁদের বক্তব্য, “আমরা আর এর মধ্যে নেই। আইনের সাহায্য নিক ওই পরিবার। আমরা ওদের সঙ্গে থাকব।” ঘটনার কথা শুনে নদিয়ার সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “অবৈধ ভাবে কেউ এসে থাকলেও, তাঁদের উপর অত্যাচার ঘটলে পুলিশ অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।” তবে অবৈধ ভাবে বসবাসের জন্য পুলিশকে ওই পরিবারের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, জানান তিনি।

সব শুনে কিশোরীর পরিবারের বক্তব্য, “এখন ভাবছি, বাংলাদেশেই আমরা নিরাপদ ছিলাম।’’

sexual assault susmit halder hanskhali teenager refugee girl
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy