Advertisement
E-Paper

পিটুলির আলপনায় দাওয়া যেন নকশিকাঁথা

কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন কিছুতেই কুলপুরোহিতকে কাছছাড়া করতে চাইতেন না হেমবরণী। যশোরের সরকার বাড়ির প্রধান কর্ত্রী আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীর দিন সতর্ক থাকতেন যাতে ‘ব্রাহ্ম মুহূর্ত’ ফস্কে না হয়ে যায়। চতুর্দশী যত ফুরিয়ে আসত, ততই ব্যস্ততা বাড়ত তাঁর। পুরোহিতকে তাড়া দিতেন, “ঠাকুরমশাই, সময় হল?” বাড়ির বউ মেয়েরা শাঁখ নিয়ে তৈরি থাকতেন।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৪২
লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতি। আনন্দনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতি। আনন্দনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন কিছুতেই কুলপুরোহিতকে কাছছাড়া করতে চাইতেন না হেমবরণী। যশোরের সরকার বাড়ির প্রধান কর্ত্রী আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীর দিন সতর্ক থাকতেন যাতে ‘ব্রাহ্ম মুহূর্ত’ ফস্কে না হয়ে যায়। চতুর্দশী যত ফুরিয়ে আসত, ততই ব্যস্ততা বাড়ত তাঁর। পুরোহিতকে তাড়া দিতেন, “ঠাকুরমশাই, সময় হল?” বাড়ির বউ মেয়েরা শাঁখ নিয়ে তৈরি থাকতেন। পঞ্জিকা হাতে নিয়ে বালিঘড়িতে সময় দেখে পুরোহিত মশাই সঙ্কেত দিতেই একসঙ্গে বেজে উঠত অনেক শাঁখ। স্মৃতি খুঁড়ে শ্বশুরবাড়ির কোজাগরীর কথা এমন ভাবেই বলছিলেন প্রভাবতী দেবী। যেন এখনও প্রতিবছর এ ভাবেই পুজো হয়!
ছাপান্ন বছর আগে যশোর ছেড়ে এসেছেন নদিয়ায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর কথা তুলতেই উৎসাহের সঙ্গে একটানা বলে গেলেন, “সেই কবে দেশ ছেড়ে এসেছি। স্মৃতিটুকু ছাড়া কিছুই আনতে পারিনি। এখানেও এখন কোজাগরীতে খুব ধুম। খাওয়া দাওয়া, আলো, বাজি পোড়ানো। কিন্তু নেই আলপনা, নেই লক্ষ্মীর ছড়া। ভেটের নাড়ু, ফালার নাড়ু, তক্তি বা নারকেলের সাঁজের নামই জানে না কেউ। ও সব ছাড়া আবার কোজাগরী হয় না কি?”
শুধু আলপনা বা ছড়া নয়। সময়ের সঙ্গে পালটে গিয়েছে পুজোর উপকরণও। কলাবউ, ঘট, লক্ষ্মীসরা ছাড়াও ওপার বাংলায় আরও এক রকম ভাবে কোজাগরী পুজো হত। বেতের ছোট চুপড়ি বা ঝুড়িতে ধান ভর্তি করে তার ওপরে দুটি কাঠের লম্বা সিঁদুর কৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হত। একে বলা হত ‘আড়ি লক্ষ্মী’। প্রভাবতী দেবীর আক্ষেপ, “এখানে সবাই দেখি প্রতিমা এনে পুজো করছে। কোজাগরী যেন নিয়মরক্ষার পুজো হয়ে উঠেছে।”
অথচ আদতে ব্যাপারটা মোটেই এমনটা ছিল না। মধ্যযুগে বণিকেরা এই পুজো করতেন। ঘোর বর্ষার পর প্রসন্ন শরতে জলপথে বাণিজ্যযাত্রার আগে হত পুজো। কোজাগরী পুজোর মন্ত্রে তার প্রতিফলনও রয়েছে— ‘নিশীথে বরদে লক্ষ্মী, কোজাগর্তী মহীতলে’। সারারাত জেগে প্রদীপ জ্বেলে পুজো দিয়ে, ভোগ নিবেদন করে তাঁকে প্রসন্ন করার চেষ্টা এই পুজো। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। ...আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পুজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা...। বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পুজা আজও অব্যাহত। ...বস্তুত, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।”

এ কথার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় বৈদিক মন্ত্রে নয়, ছড়াতে দেবীলক্ষ্মীর আরাধনা করতেন ওপার বাংলার ঘরের লক্ষ্মীরা। সেই ছড়ায় দেবীর রূপ ফুটে উঠত। বৈদিক দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে সেই দেবীর মিল কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশই নেই।

নদিয়ার রামচন্দ্রপুরে নিজের বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করতে গিয়ে শ্বশুরবাড়ির পুজোর স্মৃতিচারণ করছিলেন মালতী হালদার। তিনি জানান, ও দেশে কোজাগরী পুজো মানেই লক্ষ্মীর আলপনা আর লক্ষ্মীর ছড়া। পুরোহিত এসে ঝড়ের মতো সংস্কৃত মন্ত্র আউড়ে চারটে ফুল ফেলে দিয়ে পুজো সারবেন, এটা কল্পনাও পারতেন ওদেশের কেউ। তেমনই একটি ছড়ার স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, “উত্তর আইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া, ধুইয়া মুছিয়া কন্যা লইল বাঁটিয়া। পিটালি করিয়া কন্যা পরথমে আঁকিল, বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল।” নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “এই ধরনের পদ মৈমনসিংহগীতিকায় পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গে এই পালা খুবই জনপ্রিয় ছিল। বহু পুজোর ক্ষেত্রে বৈদিক মন্ত্রের বদলে এই ধরনের পদ বা পাঁচালি পড়ার রেওয়াজ ছিল।” অবিভক্ত বাংলার একেবারে নিজস্ব কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর অনেক কিছুই আজ আর নেই। নেই মানুষগুলো। সময়টাও বদলে গিয়েছে। সেই মাটির উঠোন, ধানের বিনুনি করা গোছা কোথায়। আলপনার স্টিকার পর্যন্ত দোকানে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। দুধ ওথলানোর সেই রেওয়াজও আর দেখা যায় কই’’।

এখনও নদিয়ার দোগাছি, জাহাঙ্গীরপুর, আনন্দনগর, শম্ভুনগরের মতো গ্রামে কোজাগরী পূর্ণিমা মানেই আলপনা। উল্লেখ্য এই সব অঞ্চলেই দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের মানুষেরা এসে বসতি গড়েছেন। আজও এই এলাকার অনেক গৃহস্থের বাড়ি সাজে পিটুলির আলপনায়। তবে প্লাস্টিকের আলপনা এখনও ঢেকে দিতে পারেনি ওই সব গ্রামের বাড়ির দাওয়া কিংবা উঠোন। এমনই এক গ্রামের বসিন্দা মেনকা পোদ্দার এককালে থাকতেন ফরিদপুরে। তিনি জানান, আমাদের ওখানে লক্ষ্মীকে বলা হত আড়ি লক্ষ্মী। বেতের ছোট ঝুড়িতে ধানভর্তি করা হত। তার উপরে দু’টি কাঠের লম্বা সিঁদুরকৌটো লাল চেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হত। কোজাগরীর রাতে পুজো হত সেই লক্ষ্মী। দেশভাগের পর এখানে এসেও আমাদের মতো অনেকেই সেই রকম লক্ষ্মীই পুজো করেন। তাতেও ছড়া কাটা হত।

মির্জাপুর গ্রামে ছোটবেলা কাটিয়ে আসা নিভাননী দেবীর কথায় পূর্ববঙ্গের গ্রামদেশে দুর্গাপুজো নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোই ছিল বড় উৎসব। কোজাগরীর রকমফের ছিল দেখার মতো। কোথাও দুর্গাঠাকুরের সমান বড় প্রতিমা। কোথাও আবার কলাবউ গড়ে পুজো, তো কোথাও সরালক্ষ্মী। মজার ব্যাপার হল লক্ষ্মীসরায় বেশির ভাগ সময়ে আঁকা থাকত রাধাকৃষ্ণ অথবা দুর্গার ছবি। পিছনে দাঁড় করানো বড় কলাগাছের গায়ে নতুন শাড়ি জড়িয়ে তৈরি কলাবউ। তার গোড়ায় লক্ষ্মীসরা আর সবার সামনে ঘট।

ছড়া কেটেই মা লক্ষ্মী আবাহন করত গৃহস্থ। করজোড়ে বাড়ির মহিলারা একসঙ্গে বলতেন, “আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি। দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি। আঁকি মাগো আল্পনা, এই পুজো এই বন্দনা।” সব ছড়ার মধ্যেই থাকে বাসনা, অভিমান এবং আকাঙ্ক্ষা। পেঁচা, কড়ি, ধানের গোলা আঁকার সঙ্গে সঙ্গে তাই ছড়া কাটা হত। “আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা। আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা।” সেই সঙ্গে থাকে মন শুদ্ধ করার বার্তাও। “আঁকিলাম আল্পনা,দূরে ফেলি আবর্জনা। শুভ শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।”

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy