ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি নয়। বিক্ষোভ কনভেন্টের পড়ুয়াদের। রবিবার রানাঘাটে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
হুমকি ছিল। দুষ্কৃতীরা এক সিস্টারকে শাসিয়েছিল ‘আই উইল কিল ইউ’ বলে! ব্যাপারটা জানত পুলিশও। তারা কিছু করেনি।
পুলিশ সক্রিয় হলে সত্তরোর্ধ্ব ‘মাদার সুপিরিয়র’ হয়তো ধর্ষিতা হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যেতেন, এই আক্ষেপই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রানাঘাটের আনাচেকানাচে। আক্ষেপ ক্রমে ক্রোধের আকার নিচ্ছে, কারণ এখনও কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
শুক্রবার রাতে একদল দুষ্কৃতী ওই কনভেন্টে ঢুকে যখন লুঠতরাজ চালাচ্ছে, তখন সিসিটিভি-র ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে তাদের মধ্যে জনা চারেককে। প্রত্যক্ষদর্শী দুই সন্ন্যাসিনীর বর্ণনা থেকে আঁকা হয়েছে দুষ্কৃতীদের ছবিও। তদন্তকারীরা কনভেন্টের অন্য সিস্টারদের সঙ্গে কথা বলে এ-ও সন্দেহ করছেন যে, ধর্ষক নাবালক হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনা হল, রবিবারেও গ্রেফতার হয়নি কেউ। অথচ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তেরা ধরা পড়বে বলে শনিবার আশ্বাস দিয়েছিল পুলিশ। সেই আশ্বাস পেয়েই জনতা রেল ও সড়ক অবরোধ তুলে নেয়। রবিবার নতুন করে আর অবরোধ হয়নি। কিন্তু স্থানীয়রা ফুঁসতে ফুঁসতে জানাচ্ছেন, তাঁরা ওই ৪৮ ঘণ্টাই অপেক্ষা করবেন। তার মধ্যে দুষ্কৃতীরা ধরা না পড়লে আরও বড় আন্দোলনে নামবেন। স্থানীয় বাসিন্দা, পেশায় স্কুলশিক্ষিকা অনিমা মণ্ডল বলেন, “ওই সন্ন্যাসিনী আমাদের মায়ের মতো। তাঁর উপরে যে নির্যাতন চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা, তা আমরা কোনও ভাবেই মেনে নেব না।”
পুলিশের অস্বস্তি এ দিন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য মহিলা কমিশন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলির মন্তব্য। এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি রয়েছে।” ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের কার্যকরী সভাপতি সুনীত ঘোষের অভিযোগ, “পুলিশ প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতে চাইছে। দুষ্কৃতীদের ধরতে পারা তো দূরের কথা, ঠিক কী ঘটেছে তা-ই এখনও পর্যন্ত পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়।” অল ইন্ডিয়া খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি অরুণ বিশ্বাসও একই অভিযোগ তুলেছেন।
মহিলা কমিশনেরই আর এক সদস্যা শিখা আদিত্য বলেন, “কনভেন্টের সন্ন্যাসিনীদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, ১৩ নভেম্বর স্কুল কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেওয়া হয়। সপ্তাহখানেক আগেও একই ঘটনা ঘটে। এখানকার প্রিন্সিপ্যাল সিস্টারকে এক দুষ্কৃতী বলেছিল‘আই উইল কিল ইউ!’ পুলিশকে তা জানানোও হয়। কিন্তু পুলিশ পদক্ষেপ করেনি।”
রবিবার কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানের শেষে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও বলেন, “কোনও ধর্মের মানুষকে অপমান করার অধিকার কারও নেই। আমি নিশ্চিত, এ বিষয়ে রাজ্য সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে।”
পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ অবশ্য নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ মানেননি। তিনি জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতের ঘটনায় আট জনকে আটক করে জেরা করা হচ্ছে। আটকদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজের মিলও পাওয়া গিয়েছে। সিআইডি সূত্রের খবর, রবিবার ওই ঘটনায় জড়িত আরও তিন জনকে চিহ্নিতকরা গিয়েছে। স্কুলের সিসিটিভি ক্যামেরা খতিয়ে দেখে এক অভিযুক্তকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সোমবার সাত অভিযুক্তের ছবি সব জায়গায় দেওয়া হবে। পুলিশ এর মধ্যেই সিসিটিভি ফুটেজ বিভিন্ন থানায় পাঠিয়েছে। দুষ্কৃতীরা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে না পারে, সে জন্য সতর্ক করা হয়েছে বিএসএফ, সীমান্ত লাগোয়া থানাগুলোকে।
এ দিন সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিনটেন্ডন্ট চিরন্তন নাগের নেতৃত্বে একটি দল রানাঘাটে আসে। সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানতে পারেন, দুষ্কৃতীদের বয়স ১৬ থেকে ২৫-এর মধ্যে। তাদের মধ্যে এক নাবালকই ধর্ষণ করেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। দুষ্কৃতীদের কয়েক জন হিন্দিতে কথা বলছিল। ‘অপারেশন’-এর সময় এক জনকে বাকি দুষ্কৃতীরা কখনও ‘দাদা’, কখনও ‘বস’ বলে ডাকছিল। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, ওই ‘বস’ বা ‘দাদা’ স্থানীয় কেউ। তদন্তকারী এক আধিকারিক বলেন, “দিন তিনেক আগে ওই স্কুলে একটা বড় অঙ্কের অনুদানের টাকা এসেছিল। দুষ্কৃতীরা যে ভাবে অনায়াসে আলমারি থেকে টাকাগুলো বের করেছে, সেটা থেকেই স্পষ্ট যে, তারা স্কুলের খুঁটিনাটি জেনেই এসেছিল।”
তা হলে সিসিটিভি থাকার কথা কি তাদের অজানা ছিল? পুলিশের দাবি, তা নয়। তদন্তকারীদের অনুমান, দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালিয়ে ফেরার সময় সিসিটিভিগুলো ভেঙে দেয়। কিন্তু যে ক্যামেরায় তাদের ফুটেজ মিলেছে, সেটা হয়তো তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাওয়ার সময় তারা খেয়াল করেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy