প্রত্যয়ী: শ্যামলকুমার দাস। নিজস্ব চিত্র
পাসপোর্ট হয়ে গিয়েছে। ইংরেজিতে কথা বলার শিক্ষা চলছে পুরোদমে। আবেদন করা হয়েছে, এখন কেবল অপেক্ষা ভিসা আসার। জুন মাসেই নিজের তৈরি, দেশের সেরা মডেল নিয়ে জাপান উড়ে যাবে মাড়গ্রাম হাইস্কুলের মাধ্যমিকের ছাত্র শ্যামলকুমার দাস।
৪ জুন থেকে ১০ জুন— জাপানের সাকুরা শহরে এশিয়ার খুদে বিজ্ঞানীদের সামনে নিজের বিজ্ঞান-মডেল নিয়ে মত বিনিময় করবে সে। তাই হতদরিদ্র ঘরের এই স্কুল পড়ুয়াকে ঘিরেই উন্মাদনা শুরু হয়েছে তার স্কুলে, গাঁ-ঘরে।
‘‘সবটাই তো স্কুলের স্যারদের সহযোগিতা। এই সহযোগিতা না পেলে ছেলে কোনওদিনই বড় হত না। এখন জাপান সরকার থেকে ভিসাটা পেলেই হয়।’’ ছেলের সাফল্যে বলছিলেন গর্বিত বাবা গোপীনাথ দাস। কারও সঙ্গে দেখা হলেই, ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছেন। পাশে থাকার কথা বলছেন। বুকের মধ্যে শিরশিরানি তাঁরও।
হস্ত চালিত তাঁতে মহাজনদের দেওয়া রেশম কাপড়ের থান বুনে বুনে সংসার চালান গোপীনাথবাবু। মাটির ঘর। সেই ঘরেই তাঁদের দিন গুজরান। এই হতদরিদ্র পরিবার থেকেই জাপানে যাবে শ্যামল।
শ্যামলের পাশে এখন স্কুলের পরিচালন সমিতি থেকে স্কুলের শিক্ষক থেকে শিক্ষা কর্মীরা। ইতিমধ্যে জাপান যাওয়ার জন্য পাশপোর্ট এর ব্যবস্থা স্কুল কর্তৃপক্ষ করে দিয়েছে। জাপান সরকারের ভিসা পাওয়ার জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক ভুট্টু সেখ বলেন, ‘‘শ্যামলের পাশে সমগ্র মাড়গ্রামবাসী আছে। উদ্ভাবনের স্বীকৃতি তাকে পেতেই হবে।’’
শ্যামল এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সে যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত তখন ২০১৩ সাল। বিজ্ঞান-মডেল প্রদর্শনীতে জেলার সেরা হয়ে শ্যামল রাজ্যে চতুর্থ হয়।
পরে একই বছরে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় সে। তার উদ্ভাবন ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর তাঁদের ‘ইন্সপায়ার অ্যাওয়ার্ড স্কিম’-এর জন্য মনোনীত করে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকেরই মেল স্কুলে পৌঁছয়। এবং জানতে পারা যায় শ্যামল-ই একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ থেকে জাপানের সাকুরা যাওয়ার জন্য মনোনীত।
কোন মডেল উদ্ভাবনের দৌলতে শ্যামল পাড়ি দেবে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার পথ?
‘‘সিমেন্টের তৈরি দুটি জলের ট্যাঙ্ক দরকার। একটির ভিতরে আর একটি ট্যাঙ্ক থাকবে। মাঝে থাকবে বালি। ট্যাঙ্কের উপর গ্রীষ্মকালে ঢাকা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে কাঠ এবং শীতকালে কাচ। ট্যাঙ্কের জল ভর্তি হওয়ার পরে ছাপিয়ে মাঝে থাকা বালিতে পড়বে। এতে ভিজে বালি লিনতাপ পদ্ধতিতে ট্যাঙ্কের বাইরের জল বাস্পীভূত হয়ে ভিতরের জলকে ঠান্ডা রাখবে।’’
তার কথায়, ‘‘গ্রীষ্মকালে জলকে ঠান্ডা রাখার জন্য তাপ প্রতিরোধক কাঠ ব্যবহার করতে হবে। শীতকালে জল গরম করার জন্য কাচ ব্যবহার করে আলোর প্রতিফলনে জল গরম হবে।’’— এক নিশ্বাসে বলতে বলতেই দু’চোখে স্বপ্ন ভর করে আসে যেন শ্যামলের।
আরও পড়ুন...
জলের উৎস খোঁজে ডাক বিশেষজ্ঞের
রোগা রোগা চেহারা। হাল্কা নীল শার্ট, গাঢ় নীল প্যান্ট। বুকের কাছে হাওয়ায় এলোমেলো দুলছে স্কুলের পরিচয় পত্রটা।
মঙ্গলবারও ইংরেজি শিখতে স্কুলে এসেছিল শ্যামল। হঠাৎ এমন মডেল বানানোর চিন্তা কেন? তার ব্যাখ্যায় সে জানায়, যারা গিজার কিনতে পারেন না, তাঁরা এই মডেল ব্যবহার করতে পারবেন। এতে বিদ্যুতের খরচ সাশ্রয় হবে।
প্রধানশিক্ষক সমীরণ মোস্তাফা বিশ্বাস, সহকারি শিক্ষক রণজয় সাহা-সহ সমস্ত শিক্ষক শিক্ষা কর্মী শ্যামলের এই সাফল্যে আমরা খুশি। তার জাপান যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে সমস্ত রকম সাহায্য করা হচ্ছে বলে জানান। শ্যামলের মা প্রভাতীদেবী বলেন, ‘‘বাবু বিদেশ যাবে, চিন্তা তো হচ্ছেই। কিন্তু আমি চাই, ও বড় হোক!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy