Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

স্কুল-মামলায় কোর্টে ধাক্কা খেলেন সভাধিপতি

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগকে ঘিরে পুরুলিয়ার সভাধিপতির ‘হস্তক্ষেপকে’ অবৈধ ঘোষণা করে স্কুলের স্টাফ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকেই মান্যতা দিল কলকাতা হাইকোর্ট। সম্প্রতি সৃষ্টিধর মাহাতোর পছন্দের প্রার্থীকে ওই পদে বসানোর নির্দেশকে খারিজ করেছেন বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৪ ০০:৩৮
Share: Save:

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগকে ঘিরে পুরুলিয়ার সভাধিপতির ‘হস্তক্ষেপকে’ অবৈধ ঘোষণা করে স্কুলের স্টাফ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকেই মান্যতা দিল কলকাতা হাইকোর্ট। সম্প্রতি সৃষ্টিধর মাহাতোর পছন্দের প্রার্থীকে ওই পদে বসানোর নির্দেশকে খারিজ করেছেন বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত। শেষমেশ সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জয়পুর বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক পদে দায়িত্ব নিতে চলেছেন কাউন্সিল মনোনীত অর্চনা চৌধুরীই।

আদালতের ওই রায় জেনে সুষ্টিধরবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “এটা নিয়ে আর আমি কিছু বলব না।”

হাইকোর্টে এমন রায়ের পরে জেলা সভাধিপতির সঙ্গে জেলা তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের মতানৈক্যও প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এক দিকে দলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো ওই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার গোটা ঘটনায় দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি তথা জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘জেলা পরিষদের একটি লিগ্যাল সেল রয়েছে। সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে জেলা পরিষদকে এমন বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হত না।”

দীর্ঘ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের পদে কে বসবেন, তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। যার সূত্রপাত হয়েছিল গত ৩১ অক্টোবরের পরে। ওই দিনই অবসর নিয়েছিলেন বিদায়ী ‘টিচার ইন চার্জ’ চিত্রা সিংহ। তিনি অবসন নেবেন বলে কয়েক দিন আগেই নিয়ম মতো পরবর্তী ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ঠিক করতে আলোচনা করে এক শিক্ষিকার নাম স্থির করে ওই স্কুলের স্টাফ কাউন্সিল। স্কুল সূত্রে খবর, তার মধ্যেই স্কুলে খবর পৌঁছয় কাউন্সিল যাঁকে মনোনীত করছে, জেলা পরিষদের শিক্ষা স্থায়ী সমিতি তাঁকে চাইছে না। সভাধিপতির ইচ্ছা মেনেই স্থায়ী সমিতি সে কথা কাউন্সিল সদস্যদের কানে তোলে বলে খবর। ওই পরিস্থিতিতে ঝামেলা এড়াতে প্রথম বার মনোনীত শিক্ষিকা দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। তখন কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মত অনুসারে অবসরের দিন চিত্রাদেবী শিক্ষিকা অর্চনা চৌধুরীকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে যান। তিনি কাজও শুরু করেন।

কিন্তু ওই সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্কুলে জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) রাধারানি মুখোপাধ্যায়ের একটি চিঠি পৌঁছয়।

২৯ অক্টোবর তারিখে লেখা ওই চিঠিতে তিনি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা চিত্রাদেবীকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন ওই পদে তাঁর সহকর্মী রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়িত্ব ভার বুঝিয়ে দেন। রাধারানিদেবী ওই চিঠিতেই স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর নির্দেশেই রুমাদেবীকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই ওই নির্দেশ মানতে পারেননি স্টাফ কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যই। তাঁরা অসন্তোষের কথা সরাসরি জেলা স্কুল পরিদর্শকের অফিসে এসে জানিয়েও যান। তাঁদের দাবি ছিল, স্টাফ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এ ভাবে নির্দেশ দেওয়া যায় না। রাধারানিদেবীর ওই সিদ্ধান্ত তাঁদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ারই সামিল।

কাউন্সিলের সদস্যদের ক্ষোভের মুখে পড়ে জেলা স্কুল পরিদর্শক সংশ্লিষ্ট স্কুল প্রশাসককে সবার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন। কিন্তু অভিযোগ, স্কুল প্রশাসক কাশিনাথ দে তা নিয়ে কোনও পদক্ষেপই করেননি। ফলে স্কুলে একপ্রকার অচলাবস্থা তৈরি হয়। স্টাফ কাউন্সিল মনোনীত নাকি জেলা স্কুল পরিদর্শকের নির্দেশিত শিক্ষিকাই স্কুলের ‘টিচার ইন চার্জ’ তা নিয়ে দেখা দেয় ধন্দ।

স্কুল সূত্রে খবর, অচলাবস্থা কাটাতে গত ২৮ নভেম্বর জেলা স্কুল পরিদর্শক, সংশ্লিষ্ট স্কুল প্রশাসক এবং জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধক্ষ ওই স্কুলে যান। সেখানে গিয়ে অর্চনাদেবী ও রুমাদেবীর মধ্যে কার দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন, তা পরীক্ষার জন্য একটি ধ্বনি ভোটও নেওয়া হয়। তাতে সৃষ্টিধরবাবুর পছন্দের প্রার্থী মাত্র ৩টি ভোট পান। ১১টি ভোট পান অর্চনাদেবী। তখন সবাই ভেবেছিলেন এ বার তা হলে সমস্যা মিটল। কিন্তু স্কুলের এক শিক্ষিকা বলেন, “আমাদের সবাইকে অবাক করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্কুলে জেলা স্কুল পরিদর্শকের একটি চিঠি পৌঁছয়। তাতে ফের বলা হয়, জেলা পরিষদের শিক্ষা স্থায়ী সমিতির নির্দেশ মোতাবেক রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ করা হল।” স্বভাবতই অর্চনাদেবী রুমাদেবীকে দায়িত্ব ভার বুঝিয়ে দেন। কিন্তু এর পরেও দমে না গিয়ে ওই নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন কাউন্সিলের একাংশ।

ওই সদস্যদের আইনজীবী অমিতপ্রকাশ লাহিড়ী জানান, আদালত রায়ে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে, ১৯৬৩ সালের ‘পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ আইন’ অনুযায়ী স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবে। জেলা স্কুল পরিদর্শক কেবল ওই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। জয়পুর গার্লসের ক্ষেত্রে জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) ওই নিয়ম মানেননি। পাশাপাশি বিচারপতি করগুপ্ত তাঁর রায়ে এটাও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, এক্তিয়ার বহির্ভূত ভাবেই জেলা পরিষদের শিক্ষা স্থায়ী সমিতি সংশ্লিষ্ট স্কুলের ‘টিচার ইন চার্জ’ নিয়োগে নাগ গলিয়েছে। তাই জেলা স্কুল পরিদর্শককে দেওয়া সমিতির নির্দেশ এবং নিয়োগ সংক্রান্ত জেলা স্কুল পরিদর্শকের নির্দেশ দু’টিই অবৈধ। স্বাভাবিক ভাবেই স্টাফ কাউন্সিলের অর্চনা চৌধুরীর ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকার পদে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তকেই হাইকোর্ট মান্যতা দিয়েছে। অমিতবাবুর কথায়, “সভাধিপতির হস্তক্ষেপ শুধু নিয়ম বহির্ভূতই নয়, সংবিধান বহির্ভূতও।”

এ দিকে রাধারানিদেবী জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ মেনে অর্চনা চৌধুরীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য স্কুল প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমন নিয়ম বহির্ভূত নির্দেশ কেন দিয়েছিলেন? কোনও মন্তব্য করতে চাননি জেলা স্কুল পরিদর্শক। আর যাঁকে নিয়ে এত বিতর্ক সেই রুমাদেবী বলেন, “জেলা পরিষদের শিক্ষা স্থায়ী সমিতি আমাকে দায়িত্ব নিতে বলেছিল। এখন আদালত ছেড়ে দিতে বলেছে, ছেড়ে দেব।” অর্চনাদেবীর প্রতিক্রিয়া, “সুবিচারের জন্য কাউন্সিলের সদস্যেরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আদালতের রায়ে সুবিচার মিলেছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

prasanta pal purulia high court teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE