—ফাইল চিত্র।
আমাদের রাজপুরুষদের মধ্যেও দেখি, রাজ্য শাসনের কোনও একটা ছিদ্র দিয়া ভয় ঢুকিলেই তারা পাশ্চাত্ত্য স্বধর্মকেই ভুলিয়া যায়, যে ধ্রুব আইন তাঁদের শক্তির ধ্রুব নির্ভর তারই উপর চোখ বুজিয়া কুড়াল চালাইতে থাকে। তখন ন্যায় রক্ষার উপর ভরসা চলিয়া যায়, প্রেস্টিজ রক্ষাকে তার চেয়ে বড় মনে করে, এবং বিধাতার উপর টেক্কা দিয়া ভাবে প্রজার চোখের জলটাকে গায়ের জোরে আন্দামানে পাঠাইতে পারিলেই তাদের পক্ষে লঙ্কার ধোঁয়াটাকে মনোরম করা যায়।”—
১৯১৭ সালে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধে ব্রিটিশ শাসনকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই লাইনগুলি আজ বড় প্রাসঙ্গিক। কেন্দ্রের বিজেপি ও রাজ্যে তৃণমূলের শাসনকালের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমে যেন হুবহু মিল। এখন পাশ্চাত্য স্বধর্ম নয়, ভারতীয় সংবিধান যেন ভুলে যাচ্ছে দুই সরকার। আইনের শাসন না রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের স্বার্থে আইনের অপব্যবহার করছে, তা নিয়েই প্রশ্ন জাগছে সাধারণ মানুষের।
বছর তিনেক ধরে সাংবাদিক হেনস্থা শাসকের ভাবমূর্তিকে বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। আইনের ঊর্ধ্বে কোনও দেশবাসী নয়। এমনকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের কর্মীদেরও আইন মেনেই কাজ করতে হয়। কারও বিরুদ্ধে কোনও আইন লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ থাকলে তা অবশ্যই আইন অনুযায়ী তদন্তসাপেক্ষ। আর আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তাদের আইনের প্রতি অগাধ আস্থা রয়েছে। শুধুমাত্র সংবিধানের ১৯(ক) ধারার উপর ভরসা রেখেই পেশাদারিত্বের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে তুলে ধরছি মানুষের কথা। অথচ রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসক দলই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে খবর সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে গ্রেফতার ও হাজতবাস এত দিন তার হাতে-গরম উদাহরণ ছিল। এমনকি রাজ্যের শাসক দলও এই নিয়ে সরব হত। হবে না-ই বা কেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেও যে নানা সময়ে সাংবাদিক-দরদি ভাবনা ফুটে উঠেছে, তিনিই আবার অপছন্দের প্রশ্নে সাংবাদিককে ‘বিরোধী’ বলতে পিছপা হননি। সঙ্গে বেড়েছিল নির্বাচনে ছাপ্পার খবর সংগ্রহে গিয়ে রাজ্যের শাসক দলের হাতে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা। এর জেরে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের নামও। এ সব এখন অতীত। ইদানীং অন্য রাজ্যকেও ছাপিয়ে সাংবাদিক নিপীড়নে যেন এগিয়ে যাচ্ছে এই ‘সোনার বাংলা’।
রাজ্যে ২০২০ সালে সফিকুল ইসলাম থেকে সেই ধারার সূচনা হয়েছিল। কারণ আমরা যারা বাম জমানা থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম তাদের খুব মনে আছে চরম পরিস্থিতিতে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি মন্তব্য। মহাকরণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি অস্বস্তিকর প্রশ্নে বলেছিলেন, “আপনাদের যা ইচ্ছে তা-ই লিখুন।” সেই মন্তব্যে সে সময় কম হইচই হয়নি। তবে গত তিন-চার বছরে এই রাজ্যে সাংবাদিক হেনস্থায় বার বার আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছে শাসককে। তাতে কী! সফিকুলের কাঁধে ঝুলেছে একাধিক মামলার বোঝা। আদালতের ভর্ৎসনা ভুলে বছর তিনেক ধরে কোনও সংবাদ রাজ্যের শাসক দল বা সরকারের বিরুদ্ধে মনে হলেই সাংবাদিকের মুখ বন্ধ করতে এসেছে নানা হুমকি। প্রয়োজনে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকের কপালে জুটেছে মারধর। ভেঙেছে ক্যামেরা। সেই দাওয়াইয়ে কাজ না হলে ‘সবক শেখাতে’ জুটেছে ভুয়ো খবর ছড়ানো থেকে মহিলার শ্লীলতাহানি, তফসিলি জনজাতি অত্যাচার প্রতিরোধ আইনের মতো কঠিন আইনি ধারা। এমনকি কোনও নোটিস ছাড়া সাংবাদিক গ্রেফতারে পুলিশি অতিসক্রিয়তার জেরে আত্মপক্ষ সমর্থনের বা আইনি পরামর্শের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না এই রাজ্যে। উগ্রপন্থী ধরার মতোই রাত থাকতেই সাংবাদিকের বাড়ি ঘিরছে পুলিশ।
বছর কয়েক আগে ভিত্তিহীন অভিযোগে পুলিশি তাড়ায় ঝাড়গ্রাম থেকে মাসখানেক পরিবার ছেড়ে থাকতে হয়েছিল এক সাংবাদিককে। গত সেপ্টেম্বরে এই রাজ্যের খড়্গপুরে চোলাই মদের রমরমায় পুলিশি ব্যর্থতার খবর প্রকাশের পরে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জুড়েছে তফসিলি জনজাতি অত্যাচার প্রতিরোধ আইনের মতো কঠোর ধারাও। তার পরে চলেছে পুলিশের অতিসক্রিয়তার পালা। ব্যস, গ্রেফতারের পরে ৯ দিন জেল! কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে সমাজের নানা স্তরে প্রতিবাদের শেষে জামিনে মুক্তি মিলেছে।
তবে শাসকের রূপ যে বদলায়নি তা দিন কয়েক ধরে চলা সাংবাদিক হেনস্থার ধারাবাহিক চিত্রনাট্য প্রমাণ দিয়েছে। সন্দেশখালিতে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারকালীন নজিরবিহীন ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে সাংবাদিক সন্তু পানকে। কলকাতা হাই কোর্ট শাসককে ভর্ৎসনা করে দ্রুত জামিন দিয়েছে সন্তুকে। একই সঙ্গে সন্দেশখালি কাণ্ডে সুমন দে-র বিরুদ্ধেও হয়েছে মামলা। সেই মামলাতেও তদন্তে স্থাগিতাদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। অবশ্য এর পরেও অতিসক্রিয় পুলিশ হানা দিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে সাংবাদিক প্রকাশ সিংহের নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে। সাংবাদিকদের আরও বড় কিছুর ইঙ্গিত দিতে আসরে উদয় হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী উদয়ন গুহ, প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “আপনার হাতে ক্যামেরা আছে বলে, আপনার লেখার ক্ষমতা রয়েছে বলে আপনি যা খুশি করে যাবেন! এর পরে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তা হলে সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হল, মিডিয়া আক্রান্ত হল, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ আক্রান্ত হল বলে কান্নাকাটি করে লাভ হবে না। আগে নিজেকে সামলান।” এমন মন্তব্যে রাজ্যের সাংবাদিক মহলের আশঙ্কা হওয়া স্বাভাবিক নয় কি?
কার কী সুফল এতে, সে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। একে তো সরকারের ভাবমূর্তি বার বার প্রশ্নের মুখে পড়ছে। কলম, বুম, ক্যামেরা নিয়ে ছুটে বেড়ানো সাংবাদিকরা যদি রাজ্যে নিরাপদ না হয় তা হলে কোথায় বাক্স্বাধীনতা— সরব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ থেকে গণসংগঠনগুলি। কিংবা বিরোধী দলনেতা। অনেকেই বলছেন, এ তো ‘সেমি-ইমার্জেন্সি’। ‘সাংবাদিক-দরদি’ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য রাজ্যবাসী শুনতে চাইলেও তিনি নীরব থাকছেন, যদিও গত সেপ্টেম্বরে সাংবাদিক গ্রেফতারে কলকাতা প্রেস ক্লাব-সহ সাংবাদিকদের বড় অংশ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার পরে তিনি জেলা পুলিশ সুপারকে বিষয়টি সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গত সেপ্টেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরে রাজ্যের পরিচিত একাধিক আইপিএস ও আইএএস পদমর্যাদার আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। যদিও সেই সুযোগ হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপ ভয়েসকলে। কারণ এই রাজ্যে এখন সাংবাদিক-সহ সর্বসাধারণের মোবাইলে কথোপকথন আর নিরাপদ নয় বলে শোনা যাচ্ছে। আইপিএস ও আইএএস অফিসারদের একাংশের দাবি, শাসকের নির্দেশে কাজ করতে হয় সকলকে। তৃণমূল সরকারের আমলে সেই কাজে আরও সিদ্ধহস্ত হতে হচ্ছে।
জানতে ইচ্ছে করে, সাংবাদিক কবে থেকে অপরাধী হল? এখনও পর্যন্ত যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাঁদের অধিকাংশ বছর দশেকের বেশি সাংবাদিকতার পেশায় রয়েছেন। এই রাজ্যের সরকারে পালাবদল হয়েছে ২০১১ সালে। তার পরে বছর দশেক ধরে রাজ্যের বুকে কাজ করে চলা এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনি ধারায় মামলা ছিল বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। অথচ গত তিন-চার বছরের মধ্যে এই রাজ্যের সাংবাদিকদের এমন অপরাধ প্রবণতা বেড়ে চলার কারণ ঘিরেই বাড়ছে বিতর্ক। ২০১১ সালের পর ‘অপরাধমনস্ক’ সাংবাদিকরা কি ততটা অপরাধ করছিলেন না? সরকার নিশ্চয় সাংবাদিকদের অপরাধে প্রশ্রয় দিচ্ছিল না? না কি চিনতে চিনতেই শাসকের দশ বছর কেটে গেল?
তবে কি আমরা সাংবাদিকরা নির্ভয়ে আর জনগণের কথা লিখব না? শাসকের মুখের সামনে তুলে ধরব না আয়না?
অবশ্যই তুলব। যদিও আমাদের আলাদা কোনও রক্ষাকবচ নেই। তবে জানি, আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অতীতে সাংবাদিকদের পাশে যে ভাবে থেকেছে, সে ভাবেই ভবিষ্যতেও থাকবে। শাসকের রক্তচক্ষু আমরা উপেক্ষা করবই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy