উদ্ধব ঠাকরে। —ফাইল চিত্র।
‘একটা বেড়ালের অনেকগুলি বাচ্চা হয়েছে। চোখ ফোটার আগেই তারা ম্যাও না বলে, ডাকতে শুরু করেছে মোদী, মোদী! খবর কানে যাওয়ায় নামের মালিক চমৎকৃত। কয়েক দিনের মধ্যেই এলেন ছানাগুলিকে দেখতে। কিন্তু কি আশ্চর্য, তাঁকে দেখেই ছানাগুলি ডাকতে শুরু করল, ঝুটা, ঝুটা..! অপ্রস্তুত সবাই গিয়ে ধরল মা-বেড়ালকে। মা-বেড়াল বলে, আসলে এখন তো ওদের চোখ ফুটে গিয়েছে, তাই ডাকের বদল!’
আসর জমিয়ে বসে এমন টুকরো টুকরো হরেক গপ্পো শোনাচ্ছেন উদ্ধব ঠাকরের ঘনিষ্ঠ নেত্রী, বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের পূর্বতন মেয়র কিশোরী পেনেকর। মহল্লার বয়স্ক, অল্পবয়সি মহিলারা হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। প্রচারের এ এক অভিনব কৌশল। মহালক্ষ্মী রেল স্টেশনের লাগোয়া ভিউইং গ্যালারি। যেখানে মুম্বই সফরকালে গোটা বিশ্বের মানুষ এসে দাঁড়ান, নীচে অতিকায় এক ধোবিখানা দেখার জন্য। বলিউডের দৃশ্যে যাকে ঘুরে ফিরে দেখতে অভ্যস্ত সবাই। আগামী সোমবার সেখানে ভোট।
চর্তুদিকে নিশানের মতো উড়ছে বেগুনি, সবুজ, নীল আরও হরেক রংয়ের কাপড়। সোডা আর কেমিক্যালের অচেনা গন্ধে ভরে আছে বাতাস। আর সেখানে দলবল নিয়ে এসেছেন পেদেনকর, তবে কোনও জনসভা করতে নয়। সঙ্গে নিয়ে আসা একটি বাক্সে মরাঠী গান বাজছে, ‘এই মশাল (উদ্ধবপন্থী শিবসেনার নতুন প্রতীক) হিন্দুস্তানের। এই মশাল গদ্দারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের। এই মশাল আমচি মুম্বইয়ের।’ ধোবিঘাটের সরু গলির কর্মব্যস্ত বাসিন্দারা কিছু ক্ষণের জন্য হাতের কাজ ফেলে ঘিরে বসেছেন তাঁকে। তিনিও মুখে মুখে গল্প বানিয়ে হাসিমুখে বলে চলেছেন অক্লান্ত।
“রাম আমাদেরও হৃদয়ে, কিন্তু পেটে আনাজের কী হবে? হাতে কাজের কী হবে? সে সব কথা বলছে না কেন বিজেপি আর একনাথ শিন্দেরা? বালাসাহেব ঠাকরের যা নীতি ছিল, উদ্ধবেরও তাই। হৃদয়ৎ রাম, হাতো মে কাম। শুধু রাম ভজনে পেট ভরে না। আমাদের দল মোদীকে হিন্দুত্ব শেখাতে পারে, শিখিয়েওছে। ভবানীমাতা, সাধুসন্ত, আখাড়া সব আছে আমাদের সঙ্গে। শঙ্করচার্যই তো মোদীর আচরণে খুশি নন। তাঁদের কথাও শুনছেন না মোদী। তিনি গোটা দেশে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে নিজের ভোটব্যাঙ্ক বাঁচাতে ব্যস্ত,” হাতের ইশারায় লাউডস্পিকারের আওয়াজ একটু কমিয়ে এক দমে বললেন শিবসেনার এই নেত্রী। “আপনারা কি ভাবছেন শিন্দে হিন্দুত্বের কারণে বিজেপিতে গিয়েছে? কয়েকশো কোটি টাকার চুরি করেছিল, জান-মাল বাঁচাতে মোদীর ওয়াশিং মেশিন-এ ঢুকেছে! ওর সঙ্গে যে সব নেতারা গিয়েছে, তাদেরও কম বেশি একই কারণ। এদের পিছনে কেমন ভাবে ইডিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমি তো জানি। কারণ, আমার কাছেও ফোন আসত। আমার লুকোনোর কিছু ছিল না, তাই ভয় দেখিয়েও টানতে পারেনি বিজেপি। মনে রাখবেন, শিন্দের সঙ্গে শুধুমাত্র দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রী গিয়েছেন, যাঁরা নীচের দিকের কর্মী, তাঁরা নন।”
গোটা মুম্বই শহর, বিজেপি এবং শিন্দেপন্থী শিবসেনার প্রার্থীর ছোট ছবির পাশে নরেন্দ্র মোদীর বড় ছবিওয়ালা প্ল্যাকার্ডে ছয়লাপ। মোদীর সরকারের কাজের ফিরিস্তিও থাকছে। তুলনায় কংগ্রেস, উদ্ধবপন্থী শিবসেনার পোস্টার কমই নজরে পড়ে। তবে দাদারের ত্রিকোণ ‘সেনা ভবনে’ তিনতলা সমান বালাসাহেব ঠাকরের ছবি দুপুর রোদে যেন গনগন করছে। ট্যাক্সি চালক সুশীল গগন যার সামনে নামিয়ে দেওয়ার আগে সশ্রদ্ধ গলায় বললেন, “বালা সাহেব যত দিন ছিলেন, অন্য কোনও নেতার হিম্মৎ ছিল না চোখ তুলে দেখে। তুলনায় উদ্ধব অনেক শান্ত ধীর মানুষ, সম্প্রদায়ের ভেদ না রেখেই সবার জন্য কাজ করেছেন, যতটুকু সময় পেয়েছেন।”
ভোটের নামমাত্র আগে স্বাভাবিক ভাবেই ফুটছে সেনা ভবনের ভিতরের তাপমাত্রা। প্রতিটি ঘরে এবং করিডরে ভিড়ের চাপ দেখে এটুকু বোঝাই যায়, বিনা যুদ্ধে এখানে মোদীকে সামান্য জমি দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই, বরং জমি কাড়ার মতোই আগ্রাসী উদ্ধবের দল। “ভোটে এটাই তো প্রধান বিষয়, শিন্দের বিশ্বাসঘাতকতা। যে বালাসাহেবের পরিবারের খেয়েদেয়ে তুমি বড় হলে, নির্বাচনী বুথ কাকে বলে শিখলে, যারা তোমাকে সব গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং মন্ত্রিত্বও দিল, শেষে ইডি, সিবিআইয়ের ভয়ে তুমি তাদেরই ধোঁকা দিলে? বালাসাহেব তিরিশ বছরে এখানে বিজেপি-কে মাথা তুলতে দেননি। অটলবিহারী বাজপেয়ীও এখানে আসতেন বালাসাহেবের কথা শুনতে। আর সেই তুমি (শিন্দে) বালাসাহেবের প্রতীক নিয়ে পালালে? গোটা মরাঠা এই ঘটনা দেখছে।” বলছেন, উদ্ধবপন্থী শিবসেনার প্রধান মুখপাত্র হর্ষল প্রধান। কথার ফাঁকেই দলের প্রচারের নতুন রিল বানানোর টিম এল। মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং পেট্রোলের দাম আকাশচুম্বী, এটাকেই মূল প্রচারের বিষয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন উদ্ধব, তাঁদের জানালেন হর্ষল। বললেন, “আগে গোটা দেশ থেকে কাম ধান্দার জন্য লোকে মুম্বই আসত। এখন আসতে ভয় পাচ্ছে, কারণ, রোজগার মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না। সব চলে যাচ্ছে গুজরাতে।”
কিন্তু গত নির্বাচনেই তো বিজেপি-র সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়েছিলেন উদ্ধব? “উনিশের লোকসভা ভোটে পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র, বেকারত্ব, নির্বাচনী বন্ডের বিষয়গুলি ছিল না। গত পাঁচ বছরে উদ্ধবও বুঝতে পেরেছেন, স্থানীয় সরকার ভেঙে নিজেদের শক্তি বাড়ানোই মোদীর আসল লক্ষ্য। উনিশে কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রীত্বের মেয়াদ ভাগাভাগি হবে শিবসেনার সঙ্গে। কিন্তু সেই কথা না রেখে উদ্ধবের ঘরই ভাঙিয়ে নিল তারা।”
মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮টি আসনের মধ্যে ৪৫টিতে বিজেপি-শিন্দে জোটের বিরুদ্ধে একের বিরুদ্ধে এক লড়াই দিচ্ছে মহাবিকাশ আগাড়ি। তিনটি আসনে লড়ছেন আগাড়ি সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা। আর মুম্বইয়ের ছ’টি আসনের চারটিতে উদ্ধবপন্থী শিবসেনা এবং দু’টিতে কংগ্রেস। আগাড়ি জোটের মধ্যে এক দলের ভোটব্যাঙ্ক অন্য দলে ঠিকমতো যাচ্ছে বলেই দাবি করছেন উদ্ধব নেতৃত্ব।
মুম্বইয়ে পা দেওয়ার পরেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অটো চালক থেকে রেল স্টেশনের স্টলের কর্মীদের সঙ্গে সামান্য কথার পরেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্ধবের পাশে থাকতে চাইছেন। অথচ বিজেপি-র কাছে মহারাষ্ট্রের বোরা মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক ছিল, যা অনেক আসনে ছোট ছোট ব্যবধানে জেতার সময়ে কাজে লেগেছিল বলে ভোট বিশেষজ্ঞদের মত। মাহিম ভেন্ডিবাজার এলাকায় অন্তত সাড়ে তিনশো বড় আবাসন (মুসলমান অধ্যুষিত) এ বার উদ্ধবের সঙ্গে রয়েছে বলেই শিবসেনার দাবি। এ ছাড়া বিভিন্ন দলিত বস্তিও বিজেপি-র ‘চারশো পারে’র হুমকিতে সন্ত্রস্ত্র হয়ে উদ্ধবপন্থী শিবসেনার সঙ্গে। এ সবের বাইরেও টের পাওয়া যাচ্ছে গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ। “কোভিডের সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উদ্ধব জাত, ধর্ম বিচার না করে সবার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করেননি। মুসলমানরা যদি ভুলে না যান, তবে তাঁদের দুয়া পাওয়ার কথা মহাবিকাশ আগাড়ির প্রার্থীদের” বলছেন জুবার আহমেদ। কোভিডের ধাক্কা সামলে বন্ধ ফ্রুট-চকো শেক-এর দোকান আবার চালু করেছেন তিনি দাদারে।
তাই শিন্দেকে সঙ্গে পেলেও মহারাষ্ট্রে গত বারের এনডিএ-র আসন সংখ্যা (৪১) ধরে রাখা এ বার কঠিন চ্যালেঞ্জ মোদীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy