Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বড়দিন আমার প্রেমের দিন, লিখছেন অঞ্জন দত্ত

শীতকালে বাঙালিদের একটা অন্য রকমের রং হয়। টিপিক্যাল বাঙালি রসগোল্লা না খেয়ে কোট-প্যান্ট পরে পায়ে চটিও গলায়।

আসলে, বড়দিনে এ শহরটা একেবারে পাল্টে যায়।

আসলে, বড়দিনে এ শহরটা একেবারে পাল্টে যায়।

অঞ্জন দত্ত
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শীতকালে বাঙালিদের একটা অন্য রকমের রং হয়। তারা ব্লেজার পরে। টিপিক্যাল বাঙালি রসগোল্লা না খেয়ে কোট-প্যান্ট পরে পায়ে চটিও গলায়। এই শীতকালের বাঙালি, বড়দিনের বাঙালি একদম অন্য রকম! এই বাঙালি নাহুম’স থেকে কেক কেনে, বর্ধমান থেকে এসে পার্ক স্ট্রিটে হাঁটে, বই কেনে, বইমেলায় যায়। আসলে, বড়দিনে এ শহরটা একেবারে পাল্টে যায়। সব দোকান সাজানো হয়, আলো জ্বলে, দেখলে বোঝা যায়, এর একটা কলোনিয়াল পাস্ট আছে! এই ফিল-টা আমার খুব পছন্দের। সারা পৃথিবীর বহু জায়গায় একটা কলোনিয়াল পাস্ট আছে, অথচ, আমার এখানে সাবেকিয়ানাটা নষ্ট হচ্ছে। অসামান্য মূর্তি ছিল সব! অসাধারণ স্ট্রাকচার! সব সরিয়ে নিয়ে গিয়ে শহরটার লুকটা পাল্টে ফেলল! কিন্তু ইতিহাসটাও যে এরই সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল, সেটা কে বুঝবে?

আরও পড়ুন: সাহেবি কেতার ক্রিসমাস পার্টির মেনুতে কী থাকবে?

আমি যে পাড়াটায় থাকি, সেটা একেবারে সেন্ট্রাল কলকাতা। কলকাতা-১৬। এখানে একটা কসমোপলিটান চেহারা আছে। একটা আর্মেনিয়ান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অতীত আছে। আমার পাড়ায় মাইক বাজিয়ে যিশুপুজো হয়। পাড়াটা তার নিজস্ব ঢঙে খ্রিস্টমাস পালন করে। তার শহরের একটা ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে চলে। আমার বাড়ির পাশে স্ট্যানলি রয়েছে, যোসেফ দাস রয়েছে। আমি কখনও খ্রিস্টান হই, মুসলিম হই, হিন্দু হই। আবার বো ব্যারাক, রিপন স্ট্রিট, ইলিয়ট রোডে একটা স্প্যানিশ স্প্যানিশ গন্ধ পাই। আমার শহরে একটা ছোট্ট স্পেন আছে! বো ব্যারাকে গেলেও স্প্যানিশ ফিল-টা পাই। নামগুলোও ভারী মজার— কার্লোস...মার্কো! কেক-ওয়াইন-মোমবাতি...সাজছে বো ব্যারাক।

খুব ছোটবেলায় এই বড়দিনের কলকাতাকে সে ভাবে পাইনি। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত দার্জিলিঙে পড়াশোনা করেছি। তখন দার্জিলিং এত ঘিঞ্জি ছিল না। এর পর যখন কলকাতায় ফিরলাম, দেখলাম কেমন এক ‘ক্যাওটিক সিচুয়েশন’! সত্তরের দশক থেকে দেখলাম কলকাতার যেখানে-সেখানে বাড়ি উঠছে। কী রকম যেন লাগত। শহরটাকে ভাল লাগত না। এত গরিব মানুষ চারদিকে, নোংরা, আবার তারই মধ্যে শহরের কোনও কোনও এলাকা পরিষ্কার। কিন্তু ধী‌রে ধীরে একটা বন্ডিং তৈরি হল!

যেমন, আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র মিনিট দু’য়েক পথ হাঁটলেই তাঁতিবাগান। সেখানে গেলেই দেখতে পাই, রাস্তায় কাবাব বানানো হচ্ছে, চতুর্দিকে বিরিয়ানির গন্ধ, বিফের গন্ধ, বোরখা, আজানের সুর— মনে হয়, আমি যেন পাকিস্তানের কোনও শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই যে কলকাতার ভিতরে ছোট ছোট জায়গা দেখি, যেন ছোট ছোট পৃথিবী— এটা খুব ইন্টারেস্টিং!

আরও পড়ুন: কেমন হবে পার্টির সাজ?

কম বয়সে সেন্ট জেমস চার্চে বড়দিনের প্রার্থনায় যেতাম মেয়েদের পাশে বসার জন্য। বাবা-মা ছেড়ে দিত। আবার প্রার্থনার শেষে সেই মেয়েটির হাতে হাত ধরে বেরিয়ে পড়তাম, হাঁটতাম, হাঁটতে হাঁটতে ওদের বাড়ি। আমার প্রথম বান্ধবী ছিল অ্যালিস্যান। ওর বাবা জার্ডিন। জন্তু-জানোয়ারের ব্যবসা করতেন। আমার বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই থাকতেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’-এ জার্ডিনের উল্লেখ আছে। নিউ মার্কেটে জার্ডিনের দোকান ছিল। বড়দিন উদযাপনের সময় ওদের বাড়ির জানলায় স্পিকার লাগিয়ে জিম রিভস-এর গান বাজাতো ওরা। সে গান ভেসে যেত সারা পাড়ায়। আহা! সে গান শুনতে শুনতে বড়দিনের মানেটাই যেন পাল্টে যেত। অ্যালিস্যান আমাদের বাড়ি আসত। আমিও যেতাম। বড়দিনে ওদের বাড়িতে ঘি-ভাত, খানিকটা আমাদের পোলাওয়ের মতো আর মিট বল খাওয়াত। অপূর্ব! কিন্তু ওরা চলে গেল অস্ট্রেলিয়া। মেরি অ্যান...মেরি মেরি অ্যান...

বেশির ভাগ খ্রিস্টমাসেই আমার প্রেম হয়েছে। প্রেমে পড়েছি আমি। সাধারণ ভাবে বাঙালি ছেলেরা যেমন সরস্বতী পুজোর সময় প্রেমে পড়ে, আমার ব্যাপারটাই ছিল উল্টো— বড়দিন! গিটার বাজিয়ে ক্লিফ রিচার্ডের গান গেয়ে মেয়েদের পটাতাম! একবার খ্রিস্টমাসে একটি বাঙালি মেয়ের প্রেমে পড়ি। প্রোপোজ করি। তবে বেশিদিন সে প্রেম টেকেনি। এম এ পড়ার সময় একবার নিউ ইয়ারে গিটার বাজিয়ে গানের সময় ছন্দার সঙ্গে আলাপ। পরে আমরা বিয়ে করি। তার আগে অবশ্য আরও অনেক ঘটনার ঘনঘটা!

আরও পড়ুন: ‘ক্রিসমাস=ক্রিকেট’

আমার প্রথম গানের অনুষ্ঠানও শীতকালে। এ বার ‘বং কানেকশন টু’-ও রিলিজ করছে জানুয়ারিতে। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, আমার কোনও ফিল্ম শীতকালে রিলিজ করুক। সেই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে এ বার। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি— এই চার মাস এই কলকাতার আবহাওয়া, মেজাজ সবই অন্য রকমের হয়ে যায়! একটা অন্য গন্ধ-রং-মেজাজ-সুর— সব মিলিয়ে আমার দার্জিলিঙের পিয়ানো টিচার মিস্টার হলের কথা মনে পড়ায় এ শহর...হান্ড্রেড মাইলস্...হান্ড্রেড মাইলস্...হান্ড্রেড মাইলস্...

নোনা দেওয়াল থেকে যিশু ছলছল চোখে হাত তুলে আশ্বাস দেয় এখনও!

আরও পড়ুন: এ বার বড়দিনে নিজেই বানান কেক, কুকিজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anjan Dutt Christmas Christmas Love Celebrities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE