রিয়া সর্দার। অস্ত্রোপচারের আগে (বাঁ দিকে) ও পরে ( ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
সে বোবা নয়, তা সত্ত্বেও প্রথম কথা বলতে এগারো বছর সময় লাগল রিয়া-র! জীবনের এগারোতম বছরে এসে সে মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে পারল এবং প্রথম চিবিয়ে খাবার খেতে পারল!
এত সময় লাগার কথা ছিল না। কিন্তু রিয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ-পাঁচটি মূল্যবান বছর পার হয়েছিল সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের তারিখের জন্য হত্যে দিয়ে। রাজ্যে দাঁতের জটিল রোগের একমাত্র রেফারাল হাসপাতাল আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ। সেখানে অস্ত্রোপচারের এত কেস বছরের পর বছর ধরে জমা যে রিয়ার অস্ত্রোপচার সহজে হবে না বুঝতে পেরেছিলেন চিকিৎসকেরা। অথচ আর দেরি হলে তাঁর মৃত্যু হতে পারত। তাই শেষ পর্যন্ত কিছু চিকিৎসক উদ্যোগী হয়ে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করলেন দার্জিলিং সাব-ডিভিশনাল হাসপাতালে। উত্তর ২৪ পরগনার মেয়ের অস্ত্রোপচার হল দার্জিলিংয়ে, তার পরে সে কথা-বলার জগতে প্রবেশ করতে পারল।
উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থানার হঠাৎগঞ্জে মা পম্পা সর্দার ও বাবা শম্ভু সর্দারের সঙ্গে থাকে রিয়া। জন্মের সময় ফরসেপ পদ্ধতিতে গুরুতর ত্রুটি থেকে যাওয়ায় তার কানের পাশে চোয়ালের সংযোগকারী হাড় আটকে যায়। অর্থাৎ চোয়াল খুলত না। মুখ খুলতে না-পারায় কথা বলা দূরে থাক, খাওয়া বা ভাল করে শ্বাস নেওয়াও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তার পক্ষে। কোনও মতে ঠোঁট- দাঁতের মধ্যে দিয়ে জোর করে চেপে চামচ ঢুকিয়ে দুধ, জল আর ডাল ঢুকিয়ে দেওয়া হত মুখে। তাও গিলতে পারত না। অপুষ্টির চরমে পৌঁছে গিয়েছিল সে। মুখের ভিতর সংক্রমণ হয়ে মাড়ি ও দাঁতে পচন শুরু হয়েছিল। কোনও স্কুল এই অসুস্থতার জন্য তাকে ভর্তি নেয়নি, স্কুলে যাওয়া হয়নি রিয়ার।
প্রথমে জেলার হাসপাতালে তাকে দেখাচ্ছিলেন রিয়ার অভিভাবকেরা। তার পর গত পাঁচ বছর ধরে অস্ত্রোপচারের জন্য কলকাতার আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের চক্কর কেটে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। রিয়ার বাবা শম্ভুবাবু দরিদ্র কৃষক। নামী বেসরকারি হাসপাতালে মেয়ের অস্ত্রোপচার করার সামর্থ ছিল না। এ দিকে আর আহমেদ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীদের ‘ওয়েটিং লিস্ট’ কখনই ৩০০-র কম হয় না। রিয়া একটু-একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পম্পাদেবীর কথায়, “মেয়েটা খিদেতে আর মুখের ভিতর সংক্রমণের যন্ত্রণায় ছটফট করত, মুখ খুলে কাঁদতেও পারত না, গোঙাত, কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা প্রত্যেক বার বলতেন, ডেট দেওয়া যাচ্ছে না, প্রচুর লাইন। মাঝেমাঝে মনে হত যে মেয়েটাকে মেরে ফেলে আমরা নিজেরাও মরে যাই।”
রিয়ার চিকিৎসকদের অন্যতম আর আহমেদ হাসপাতালের ওরাল মেডিসিন বিভাগের রাজু বিশ্বাস জানান, আর আহমেদ হাসপাতাল দাঁতের জটিল রোগের ক্ষেত্রে রাজ্যের একমাত্র রেফারাল হাসপাতাল। অথচ বছর তিনেক আগেও তাদের নিজস্ব ওটি ছিল না। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের একটি অপারেশন থিয়েটার আর আহমেদ হাসপাতাল ভাগাভাগি করে ব্যবহার করত। ফলে পাহাড় প্রমাণ কেস জমে গিয়েছিল। শিশুদের অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়ার মতো অ্যানাসথেটিস্টও ছিলেন না। গত দেড় বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলালেও জমে থাকা কেসগুলি একের পর এক করতে গিয়ে রিয়ার মতো অনেকে এখনও ডেট পাচ্ছিল না।
এ দিকে রিয়ার অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারছিলেন হাসপাতালেরই কয়েক জন চিকিৎসক। এঁরা স্বরূপ নগরে নিজ উদ্যোগে একটি অবৈতনিক ক্লিনিক চালান। সেই ক্লিনিকেও কয়েকবার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন শম্ভু ও পম্পা। অস্ত্রোপচারে আর দেরি হলে রিয়ার বাঁচা মুশকিল হবে জানতেন ওই চিকিৎসকেরা। রিয়ার বাবা শম্ভুবাবু বলেন, “ডাক্তারবাবুরাই অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে রিয়ার অস্ত্রোপচার করানোর পরিকল্পনা করেন। আর আহমেদ হাসপাতালের ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন শুভ্রাংশু দত্ত দার্জিলিং সাব ডিভিশন্যাল হাসপাতালে বদলি হয়েছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই সেখানেই অস্ত্রোপচার করা হবে ঠিক হয়।” চলতি বছর জানুয়ারিতে ওই অস্ত্রোপচারে আর আহমেদের কয়েক জন ডাক্তারবাবু ছাড়া সহেলি মজুমদার, মহম্মদ আরিফ হোসেনের মতো কয়েকজন বেসরকারি চিকিৎসক নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে উপস্থিত ছিলেন। তাতে সফল হয় অস্ত্রোপচার। মুখের ব্যায়াম আর স্পিচ থেরাপি চালু হয় রিয়ার।
ঠিক মাসখানেক আগে প্রায় স্পষ্টভাবে একটা গোটা বাক্য বলতে পেরেছে রিয়া। এগারো বছর বয়সে তার বলা প্রথম বাক্য। সে দিন পাড়ায় মিষ্টি বিলিয়েছেন পম্পাদেবী। আর আহমেদ হাসপাতালে চেকআপে এসে মায়ের কোল ঘেঁষে বসেছিল রিয়া। এখন সে চিবিয়ে কচুরিও খেতে পারে। ওজন বেড়েছে অনেক। চিকিৎসকেরা জানালেন আর বছর দেড়েকের মধ্যে রিয়া সমবয়সীদের সঙ্গে সমান তালে কথা বলতে পারবে। যা শুনে একগাল হেসে সামান্য জড়ানো উচ্চারণে রিয়া ডাক্তারকাকুর হাত জড়িয়ে ধরল বলে, ‘‘থ্যাঙ্ক ইউ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy