Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
স্থগিত প্রকল্প

নিজেদের পরীক্ষাতেই সন্দিহান স্বাস্থ্য দফতর

প্রথমে জানিয়েছিল, সিরাপের মান ঠিক নেই। পরে নিজেদের পরীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তারা! স্বাস্থ্য দফতরের এই আচরণে রাজ্যে স্থগিত হয়ে গেল শিশুদের সিরাপ খাওয়ানোর প্রকল্প। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, জন্মের পরেই বহু শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। সরকারি হিসেবে, রাজ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে সংখ্যাটা শতকরা ৭০ জন।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫০
Share: Save:

প্রথমে জানিয়েছিল, সিরাপের মান ঠিক নেই। পরে নিজেদের পরীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তারা! স্বাস্থ্য দফতরের এই আচরণে রাজ্যে স্থগিত হয়ে গেল শিশুদের সিরাপ খাওয়ানোর প্রকল্প।

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, জন্মের পরেই বহু শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। সরকারি হিসেবে, রাজ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে সংখ্যাটা শতকরা ৭০ জন। তাদের মধ্যে ছয় থেকে ষোলো মাসের শিশুদের আয়রন সিরাপ খাওয়ানোর জন্য মে-জুন থেকে ‘জাতীয় আয়রন প্লাস ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রকল্পে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের সিরাপ খাওয়ানোর কথা। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, রাজ্যে দরপত্র ডেকে শ্রীরামপুরের এক ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়। সংস্থাটির ৭৩ লক্ষ বোতল সিরাপ সরবরাহের কথা। ৬৫ লক্ষ বিভিন্ন জেলায় পৌঁছেও গিয়েছে। আড়াই মাস ধরে শিশুদের সিরাপ খাওয়ানোও হচ্ছে।

এর পরেই বিতর্ক শুরু। স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তা জানান, অগস্টে লক্ষ লক্ষ বোতলের মধ্যে ১২টি ব্যাচের সিরাপ নমুনা হিসেবে নিয়ে কনভেন্ট রোডে সরকারি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষা করে জানানো হয়, সিরাপের মান ঠিক নেই। এর কয়েক দিন পরেই আবার স্বাস্থ্য ভবনকে চিঠিতে পরীক্ষাগারের এক কর্তা জানান, আগের রিপোর্টটি নিয়ে তাঁরা নিজেরাই সন্দিহান! কারণ, নতুন ফর্মুলায় তৈরি ওই সিরাপ পরীক্ষার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষাগারে নেই। এই নিয়ে ধোঁয়াশার জেরে অগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে রাজ্যে প্রকল্পটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধই করে দেয় সরকার।

এর পরেই ‘সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম’ এবং ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিসেস ডক্টরস’-এর মতো সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে, রাজ্যের এক মাত্র সরকারি ড্রাগ ল্যাবরেটরির পরীক্ষকদের যদি নিজেদের পরীক্ষার উপরেই বিশ্বাস না থাকে, তবে এমন ল্যাবরেটরি রেখে লাভ কী? তাদের বক্তব্য, এই ঘটনার পরে সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস (সিএমএস) এবং ড্রাগ কন্ট্রোলের পাঠানো ওষুধের নমুনা পরীক্ষা কতটা সঠিক হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। সংগঠনের পক্ষ থেকে গবেষণাগারের অধিকর্তার শাস্তি দাবি করা হয়েছে। জবাবে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত। দফতরের উপর মহলেও কথা হয়েছে। এর জন্য দায়ীদের রেয়াত করা হবে না।”

কিন্তু রাজ্যে ওষুধ পরীক্ষার কী হবে? সরকারি গবেষণার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, ভিন্ রাজ্যের সাতটি পরীক্ষাগারের সঙ্গে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর চুক্তি করেছে। সেখানেই বেশির ভাগ নমুনা পাঠানো হয়। এখানকার পরীক্ষাগারে খুব কম সংখ্যক নমুনাই যায়। তা পরীক্ষার মতো আধুনিক যন্ত্রও নেই। এই নিয়ে বিতর্ক উঠলেই তা পুনরায় পরীক্ষার জন্য ভিন্ রাজ্যে পাঠানো হয়। এই ক্ষেত্রে পাঁচটি ব্যাচের সিরাপও পাঠানো হয়েছে।

গবেষণাগারের অধিকর্তা অমল ধর অবশ্য মেনে নিয়েছেন, প্রথমে নিশ্চিত না হয়ে তড়িঘড়ি লিখিত রিপোর্ট দেওয়াটা ভুল হয়েছিল। তিনি বলেন, “পরে দেখা যায় পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। তখনই স্বাস্থ্য দফতরকে তা জানানো হয়।” কিন্তু ইতিমধ্যেই সিরাপটি খেয়ে ফেলছে কয়েক লক্ষ শিশু। তার কী হবে? স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র কথায়, “এটা পদ্ধতিগত অসুবিধা। দেশের প্রায় সব রাজ্যেই এই একই নিয়ম। মানুষকে এই ওষুধ দেওয়ার আগে যদি স্বাস্থ্য দফতর তা পরীক্ষা করে মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারত, তা হলে ভাল হত। কিন্তু এ জন্য নীতি নির্ধারকদের নতুন নিয়ম তৈরি করতে হবে।”

সিরাপ প্রস্তুতকারক সংস্থার এগ্জিকিউটিভ অফিসার ভবানীপ্রসাদ দে-র দাবি, “আমাদের ওষুধ যথার্থ মানের। ওরা বলছে, সিরাপে যতটা ফলিক অ্যাসিড থাকার কথা, তা নেই। কিন্তু সরকারি গবেষণাগারের পরীক্ষা পদ্ধতিই ভুল। স্বাস্থ্য দফতরে দীর্ঘদিন ওষুধ সরবরাহ করছি। কোনও দিন ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।”

বিতর্কিত সিরাপের বোতল বেশি গিয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগনা, হাওড়া ও হুগলিতে। এই তিন জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, সিরাপ খেয়ে কোনও শিশুর শরীর খারাপের খবর নেই। চিকিৎসকদের মতে, সিরাপে ফলিক অ্যাসিড কম ছিল ধরে নিলেও তা খেয়ে শরীর খারাপ হওয়ার কথা নয়। তবে রক্তাল্পতার সমস্যায় সিরাপে ফলিক অ্যাসিড কম থাকলে কোনও কাজে দেবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay National Iron Plus Initiative
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE