Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার ‘খোঁয়াড়’: কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতাল

মৃতের পাশেই রোগীর ঠাঁই, ওয়ার্ডই যেন মর্গ

মুমূর্ষু যক্ষ্মা রোগীরা হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে ধুঁকছেন। আর ঠিক তাঁদের পাশে ওয়ার্ডের মধ্যেই একটি শয্যায় পড়ে রয়েছে সাদা চাদরে ঢাকা অন্য এক রোগীর মৃতদেহ! প্রত্যন্ত জেলায় নয়, খাস কলকাতার যাদবপুরে কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে এমনই অবস্থা চলছে। হাসপাতালে মৃতদেহ রাখার মর্গ প্রায় তিন বছর ধরে অচল।

ছবি এঁকেছেন সুমিত্র বসাক

ছবি এঁকেছেন সুমিত্র বসাক

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫৫
Share: Save:

মুমূর্ষু যক্ষ্মা রোগীরা হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে ধুঁকছেন। আর ঠিক তাঁদের পাশে ওয়ার্ডের মধ্যেই একটি শয্যায় পড়ে রয়েছে সাদা চাদরে ঢাকা অন্য এক রোগীর মৃতদেহ!

প্রত্যন্ত জেলায় নয়, খাস কলকাতার যাদবপুরে কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে এমনই অবস্থা চলছে। হাসপাতালে মৃতদেহ রাখার মর্গ প্রায় তিন বছর ধরে অচল। তাই এটাই দস্তুর। যতক্ষণ না বাড়ির লোক এসে মৃতদেহ নিয়ে যাবেন, ততক্ষণ হাসপাতালের শয্যায় বাকি রোগীদের মাঝখানেই ওই ভাবে পড়ে থাকবে মৃতদেহ। দূর গ্রামে থাকা মৃতের আত্মীয়স্বজনের অনেক সময়ে হাসপাতালে আসতে দু’-তিন দিন পেরিয়ে যায়। মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে পচন শুরু হয়ে দুর্গন্ধ বেরোনো মৃতদেহও ওই ভাবে ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে থাকে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি এর প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি লিখেছেন একাধিক রোগীর আত্মীয়। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, এ ভাবে মৃতদেহের মাঝখানে থাকতে বাধ্য হওয়া কি রোগীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়?

কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে শয্যা-সংখ্যা ২০০। সব সময়েই ১০০-১৫০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার সমস্ত ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর) যক্ষ্মা রোগীদের (যাঁদের দেহে যক্ষ্মার প্রচলিত ওষুধ কাজ করে না) চিকিৎসার জন্য এটিই একমাত্র রেফারাল হাসপাতাল। অথচ, সেই হাসপাতালের মর্গ গত প্রায় তিন বছর ধরে অচল। তা-ও এত দিন হাসপাতালে কারও মৃত্যু হলে অ্যাম্বুল্যান্সে করে এসএসকেএম বা এম আর বাঙুর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের চালক না-থাকায় অন্য হাসপাতালের মর্গে মৃতদেহগুলিকে পাঠানো যাচ্ছে না।

তাই বলে হাসপাতালের শয্যাতেই দেহ ফেলে রাখা হবে? হাসপাতালের সুপার বিনয়রঞ্জন প্রধানের উত্তর, “কী করা যাবে? ডোম নেই, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরও আকাল। কাকে দিয়ে মৃতদেহ সরাব? সরিয়ে রাখবই বা কোথায়?” তাঁর বক্তব্য, “মাসে আট-ন’জন করে রোগী মারা যান এই হাসপাতালে। আমরা চেষ্টা করি যাতে একটু আলাদা জায়গায় মৃতদেহ আড়াল করে রাখা যায়, কিন্তু সব সময়ে সম্ভব হয় না।”

কিন্তু হাসপাতালের নিজস্ব মর্গ চালু করছে না কেন স্বাস্থ্য দফতর? সুপারের যুক্তি, “অসংখ্য বার স্বাস্থ্য দফতরে জানানো হয়েছে। চিঠি লিখেছি। মাঝে এক বার পূর্ত দফতর মর্গ সংস্কারে পাঁচ লক্ষ টাকা বাজেট দিয়েছিল, তার পরে আর কাজ এগোয়নি। এমনকী, অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভারের ব্যবস্থাও এত মাসে হল না।” বিষয়টি শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। বলেছেন, “আমাকে তো এ সব কিছুই জানানোই হয়নি। এই ভাবে রোগীদের মাঝখানে মৃতদেহ ফেলে রাখা যায় নাকি! আমি জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি দেখব।”

আর স্বাস্থ্য দফতরের যক্ষ্মা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার শান্তনু হালদারের প্রতিক্রিয়া, “ওই যক্ষ্মা হাসপাতালে মর্গ নেই বুঝি! জানতাম না তো! আমি শুধু অ্যাম্বুল্যান্সের চালকের সমস্যাটা শুনেছিলাম। সরকারি প্রক্রিয়ায় নতুন চালক নিয়োগে একটু সময় লাগছে।”

সুতরাং এ ভাবেই গত ফেব্রুয়ারি থেকে এই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছে। ওই হাসপাতাল থেকে সদ্য ছুটি পাওয়া ব্যারাকপুরের বাসিন্দা এক এমডিআর যক্ষ্মা রোগী নিজের অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে জানান, গত মাসে তাঁর ঠিক পাশের শয্যায় পূর্ব মেদিনীপুরের এক এমডিআর যক্ষ্মা-আক্রান্ত যুবকের মৃত্যু হয়। তাঁর বাড়ির লোক মৃতদেহ নিতে আসতে চাইছিল না। ফলে টানা দু’দিন মৃতদেহ ঠিক ওই ভাবে তার পাশের শয্যায় পড়েছিল। তাঁর কথায়, “শরীরে একেই যন্ত্রণা। তার উপরে সাদা চাদরে ঢাকা দেহ ঠিক পাশের খাটে। দু’দিন ভাল করে খেতে-ঘুমোতে পারিনি।”

হাসপাতালে ভর্তি উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা আর এক এমডিআর যক্ষ্মা রোগীর বাবা জানান, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তাঁর ছেলের পাশের শয্যায় এক রোগীর মৃত্যু হয়। হাওড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৃতের বাড়ি। খবর পেয়ে বাড়ির লোকের আসতে প্রায় আট-নয় ঘণ্টা সময় লাগে। ওই ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বলেন, “অতক্ষণ প্রায় সমবয়সী যুবকের মৃতদেহের পাশে থেকে আমার ছেলের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, যে কোনও মুহূর্তে ওরও মৃত্যু হবে। বাঁচার আশাই নেই। সেই অবসাদ থেকে এখনও পুরোপুরি বেরোতে পারেনি। সরকারি হাসপাতালের কাছে কি ন্যূনতম মানবিকতাও আশা করতে পারব না?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay ks roy tb hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE