সমাপতন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের ডেকে কার্যত তিরস্কার করছেন, তখন খবরের শিরোনামে কেনেথ অ্যারো। ১৯৬৩ সালে যে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন, ‘‘গোটা সমাজ একমত, স্বাস্থ্য পরিষেবাকে শুধু বাজারের হাতে ছে়ড়ে দেওয়ার চিন্তাটাই অসহনীয়।’’
বাজার ব্যবস্থার বিরোধী নন, বরং, বাজার অর্থনীতির যুক্তিকে অকাট্য গাণিতিক প্রমাণ জুগিয়েছিলেন তিনি। সেই কাজের জন্যেই ১৯৭২ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন মাত্র ৫১ বছর বয়সে, জন হিকস-এর সঙ্গে যুগ্ম ভাবে। আমৃত্যু অর্থনীতিতে সব চেয়ে কম বয়সি নোবেলজয়ীর শিরোপা থাকল তাঁরই।
২১ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টো-য় ৯৫ বছর বয়সে মারা গেলেন কেনেথ অ্যারো। বহু অর্থনীতিবিদের মতে, বিশ শতকে অর্থনীতির দুনিয়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী তাত্ত্বিক। অমর্ত্য সেন থেকে জোসেফ স্টিগলিটজ, অনেকেই তাঁর কাজে প্রভাবিত।
তাঁর নামের সঙ্গে যে তত্ত্বের যোগ অবিচ্ছেদ্য, সেটি হল ‘ইম্পসিবিলিটি থিয়োরেম’। যে কোনও প্রশ্নেই প্রতিটি মানুষের নিজস্ব পছন্দ বা বাছাই আছে। সেগুলির থেকে যদি একটি সন্তোষজনক সামাজিক বাছাই বা চয়নে পৌঁছতে হয়, তবে তার জন্য কয়েকটি ন্যূনতম শর্ত পালন করতে হবে। অ্যারো দেখিয়েছেন, সেই শর্তগুলির সব ক’টা পূরণ করা সম্ভব নয়। এই তত্ত্ব সামাজিক চয়নের সমগ্র ধারণাটাকেই বদলে দিয়েছে বললে বেশি বলা হবে না।
কোনও একটি আদর্শ অবস্থা থেকে বিচ্যুত হওয়া আসলে কতখানি সহজ, এবং সেই আদর্শে অটল থাকতে গেলে কতটা সাবধানী হতে হবে, তা দেখিয়ে দেওয়াই বোধ হয় ছিল অ্যারোর অর্থনৈতিক দর্শন। যে ‘জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম’ মডেল নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকার জন্য তাঁর নোবেল জয়, সেটি অর্থনীতির তত্ত্বের ভিত্তিস্বরূপ। অ্যাডাম স্মিথ যে বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’-এর কথা বলেছিলেন, এই মডেল তারই বিশদ গাণিতিক রূপ। কিন্তু, অ্যারো সারা জীবন ধরে দেখিয়ে গিয়েছেন, বাজারের অদৃশ্য হাতের কল্যাণে অর্থনীতি শ্রেষ্ঠ অবস্থায় থাকবে— এমনটা হওয়ার জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, তা কতখানি অবাস্তব। বাজার ব্যবস্থার ফাঁকগুলোকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনিই। তার থেকে নিস্তারের পথও বাতলে দিয়েছেন। বিশ শতকের খুব কম অর্থনীতিবিদের কাজই সাধারণ মানুষের জীবনে এত প্রভাব ফেলেছে।
কৌশিক বসুর সংযোজন: কেনেথ অ্যারোর মৃত্যু অর্থনীতির দুনিয়ার জন্য অতি দুঃখের খবর। কেইনস এবং স্যামুয়েলসনের মতো তিনিও ছিলেন গত একশো বছরের সেরা অর্থনীতিবিদদের এক জন। তা ছাড়া, তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ— বিনয়ী, সহমর্মী।
আমি একটা বই সম্পাদনা করছি। তাতে তাঁরও লেখা দেওয়ার কথা। গত সপ্তাহেই ই-মেলে জানিয়েছিলেন, শরীর খারাপ থাকায় লেখাটা শেষ করতে পারেননি। তিনি দুঃখিত। আমি তাঁকে ফোন করলাম। বললাম, কোনও তাড়া নেই, তাঁর শরীরের দাবি সবার আগে। ওঁর গলাটা দুর্বল ছিল, কিন্তু পরিচিত উষ্ণতার অভাব ছিল না। বললেন, এখনও নতুন চিন্তা তাঁকে উদ্দীপিত করে। খুব শিগগিরই লেখাটা শেষ করে পাঠিয়ে দেবেন।
২১ ফেব্রুয়ারি জানিয়ে দিল, লেখাটা আর কোনও দিন আসবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy