সন্ত্রাস চালাতে খরচা আছে। আর সেই অর্থ তুলতে না পারলে খরচার খাতায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সন্ত্রাসবাদ দমনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি অর্থের জোগান বন্ধ করার উপরে খুবই গুরুত্ব দেন। ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সেই অর্থের জোগানে কি এখন ভাটার টান? গোয়েন্দা সূত্র কিন্তু সে রকম সঙ্কেতই দিচ্ছে।
২০১৪-এর প্রথম দিক। সিরিয়া হয়ে ইরাক ঢুকছে আইএস। সেই ঝড়ের সামনে সব প্রতিরোধ উড়ে যাচ্ছে। তখনই মার্কিন সেনার জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ-এর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি মার্কিন সংসদের ‘হাউজ ইন্টালিজেন্স কমিটির’-কে জানিয়েছিলেন, অর্থ, অস্ত্র আর লোকবলে এ যাবৎ কালের সব জঙ্গি সংগঠনকে ছাপিয়ে গিয়েছে আইএস। অর্থ না থাকেল কিন্তু অস্ত্র আর লোকবলেও টান পড়ে। কিন্তু কী ভাবে আইএস অর্থ ভাণ্ডার ফুলেফেঁপে উঠল?
জঙ্গি সংগঠনগুলি সাধারণ তিন ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে। এক, হুমকি দিয়ে। দুই, নানা ব্যবসার মাধ্যমে। তিন, কোনও সমমোনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রের গোপান সহায়তায়। আইএস-এ তিনটি ক্ষেত্রকে পূর্ণ ব্যবহার করেছে।
এখন কোনও সংস্রবের কথা অস্বীকার করলেও সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী প্রাথমিক ভাবে যে আইএস-কে সাহায্য করেছিল তা নিয়ে সংশয় নেই। মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে এটা অপ্রত্যাশিতও নয়। তবে এখন বিশ্ব সন্ত্রাসের প্রধান শক্তি হয়ে ওঠায় আইএস-এর সেই অর্থপ্রাপ্তি বন্ধ। কিন্তু আইএস-এর মূল বাড়বাড়ন্ত অর্থ জোগাড়ের প্রথম দু’টি মাধ্যমকে ব্যবহার করে।
সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল অংশ যে অংশ আইএস-এর দখলে ছিল সেখানে বেশ কিছু খনিজ তেলে সম্বৃদ্ধ অঞ্চল আছে। এই তৈল ভাণ্ডার আইএস-এর ভাগ্য খুলে দেয়। তেল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রযুক্তিবিদ ও কর্মীদের লোভনীয় বেতন দিয়ে তেল উত্তোলনের কাজে লাগায়। তেলের চাহিদা সব সময় তুঙ্গে। ফলে বাজারে সেই তরল সোনা চড়া দামে বেচতে পেড়েছে আইএস। মজার কথা হল, গোয়েন্দা তথ্য বলছে আইএস-এর থেকে তেল কিনেছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ-এর সরকারও। এর পাশাপাশি এক সময়ে সিরিয়া ও ইরাকের প্রত্নস্থল লুণ্ঠন করে তাও কালোবাজারে বেচেছে আইএস।
পাশাপাশি অর্থ তোলার প্রথম ক্ষেত্রটিকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে আইএস। তবে হুমকি নয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে প্রায় সরকারি কর সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে। করের হারও খানিক বেশি। পরিচিত কর তো আছেই সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন নতুন কর। যেমন নিজেদের স্বঘোষিত রাজধানী রাকার বাজারে দোকান পিছু প্রতি দিন সাফাই করতে ৫ থেকে ৭ ডলার নেওয়া হয়। যেমন আছে প্রবেশ কর। কিছু দিন আগেই নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ীর কথা সামনে এসেছিল। আইএস-এর নিয়ন্ত্রনাধীন অঞ্চলে মালপত্র নিয়ে যেতে প্রতি বার তাঁকে ৩০০ ডলার কর দিতে হত। পাশাপাশি নতুন নতুন করও বসিয়েছে আইএস। নানা ছোটখাটো অপরাধে ধরা পড়লে অপরাধ অনুযায়ী উত্তম-মধ্যম দিয়ে অর্থ দিয়ে নিষ্কৃতি মেলে। যেমন, ধূমপান করা বারণ। ধরা পড়লে প্রায় ৪০ ডলার গুণে দিতে হবে। এবং এই সব কর সংগ্রহের ব্যাপারে বেশ নিষ্ঠ আইএস-এর জঙ্গিরা। কর সংগ্রহের জন্য নাকি জঙ্গিদের ডিউটি শিফট ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এক শিফটে যুদ্ধ, অন্য শিফটে কর সংগ্রহের মতো কাজ।
এ ছাড়াও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুঠ করেও অর্থ সংগ্রহ করেছে আইএস। যেমন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরাকের মসুল শহর দখলের পরে ব্যাঙ্ক লুঠে আইএস-এর প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার পায়।
সব মিলিয়ে কতটা বিপুল এই সম্পদ? গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। অর্থের এই মধুভাণ্ড বিদেশ থেকে আসা জঙ্গিদের অন্যতম আকর্ষণ। শুধু মতাদর্শে চিড়ে ভেজে না।
কিন্তু এই ভাঁড়ারে টান পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে ধীরে ধীরে তেলের উৎপাদন কমছে। কারণ, রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের প্রবল বোমাবর্ষণে বেশ কিছু খনিজ তেল উৎপাদন কেন্দ্রের দফারফা হয়েছে। ধাক্কা খেয়েছে তেল সরবরাহের ব্যবস্থাও। চড়া বেতন দিলেও প্রযুক্তিবিদ, কর্মীরা থাকতে চাইছেন না। গোপনে, চোরাচালানকারীদের সহায়তায় আইএস-এর চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্য দিকে, আইএস এলাকা ছেড়ে সাধারণ বাসিন্দারা পালাচ্ছেন। এক দিকে ক্রমাগত বিমানহানা, অন্য দিকে দুর্বিষহ জীবন— দুইয়ের মাঝে হাসফাঁস সাধারণ বাসিন্দারা। অতএব পালিয়ে যাওয়া। তার জন্যই বেশ খরচ করতে হচ্ছে। ধরা পড়লে মৃত্যুর ভয়। তা সত্ত্বেও আইএস-এর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছাড়ার হিড়িক কমছে না। আইএস জঙ্গিদের বড় সময় যাচ্ছে এই বাসিন্দাদের পালিয়ে যাওয়া আটকাতে। আর বাসিন্দা কমতে থাকলে করও কমবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy