Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
International News

চিনের রক্তচাপ বাড়িয়ে আফ্রিকার শিঙের কাছেই সামরিক ঘাঁটি ভারতের

ভারতের বিদেশ সচিব এস জয়শঙ্কর স্যেশেলসের রাজধানী ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। গতকাল অর্থাৎ শনিবার চুক্তিপত্রে সই হয়েছে বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর। স্যেশেলসের শাসক এবং বিরোধী, দুই দলই এই চুক্তিকে সমর্থন করছে।

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেমস মিশেলের সময়েই স্যেশেলসের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল ভারত। কিন্তু পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের গরিষ্ঠতার অভাবে সে চুক্তি আটকে যায়। সেই বাধা অবশেষে কাটল। —ফাইল চিত্র।

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেমস মিশেলের সময়েই স্যেশেলসের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল ভারত। কিন্তু পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের গরিষ্ঠতার অভাবে সে চুক্তি আটকে যায়। সেই বাধা অবশেষে কাটল। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ১৮:০৩
Share: Save:

দেশের বাইরে সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়ানোর পথে নয়াদিল্লি। ভারত মহাসাগরের বুকে সামরিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য দ্বীপরাষ্ট্র স্যেশেলসের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। হর্ন অব আফ্রিকা থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে, অ্যাসাম্পশন আইল্যান্ডে ভারতীয় সামরিক পরিকাঠামো বাড়ানোর প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়ে দিল স্যেশেলসের ক্যাবিনেট। তার পরই নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হল দু’দেশের মধ্যে।

ভারতের বিদেশ সচিব এস জয়শঙ্কর স্যেশেলসের রাজধানী ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। গতকাল অর্থাৎ শনিবার চুক্তিপত্রে সই হয়েছে বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর। স্যেশেলসের শাসক এবং বিরোধী, দুই দলই এই চুক্তিকে সমর্থন করছে। ফলে চুক্তিতে স্যেশেলস পার্লামেন্টের সিলমোহর পড়া সময়ের অপেক্ষা।

ভারত মহাসাগরে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষ্যে পূর্বে এবং পশ্চিমে অনেকগুলি দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়াচ্ছে ভারত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থাৎ ভারত মহাসাগরের পূর্বাংশে ভিয়েতনাম, ব্রুনেই এবং ফিলিপিন্সে ভারতীয় নৌসেনার নিয়মিত উপস্থিতি রয়েছে। ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাংশেও একই ভাবে সামরিক উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে স্যেশেলস এবং মরিশাসের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে আলোচনা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি

আরও পড়ুন: ১০ আসিয়ান দেশের ২৭ সংবাদপত্রে ছাপা হল মোদীর লেখা

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্যেশেলস সফরের সময়েই সে দেশের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলেছিল ভারত সরকার। কিন্তু সে চুক্তি রূপায়ণের পথে বাধা তৈরি হয়। কারণ স্যেশেলসের পার্লামেন্টে চুক্তি রূপায়ণের প্রস্তাবটি আটকে যায়। সেই থেকে ঝুলেই ছিল চুক্তি। যে প্রেসিডেন্টের আমলে চুক্তি হয়েছিল, সেই জেমস মিশেল ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হন ড্যানি ফরে। ২০১৭ সালে ড্যানি ফরে জানিয়ে দেন, ভারত-স্যেশেলস চুক্তি আইনি ভাবে বৈধ নয়। তিনি বলেন, ভারতের তরফে ওই চুক্তির আইনি বৈধতা থাকলেও, স্যেশেলসের তরফে নেই, কারণ স্যেশেলসের পার্লামেন্ট ওই চুক্তিতে অনুমোদন দেয়নি। চুক্তিটি নিয়ে যে নতুন করে ভাবতে হবে, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট করেই দেন ফরে।

ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে আফ্রিকার কাছাকাছি ভারতের সামরিক ঘাঁটি গড়ে ওঠা চিনের পক্ষে মোটেই স্বস্তির বিষয় নয়। —ফাইল চিত্র।

এর পরেই ফের সক্রিয় হয় ভারত। বিদেশ সচিব এস জয়শঙ্কর ২০১৭-র অক্টোবরে স্যেশলসে যান। শুধু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নয়, বিরোধী দলের সঙ্গেও তিনি বৈঠকে বসেন। কারণ স্যেশেলসের পার্লামেন্টে (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) প্রেসিডেন্টের দল সংখ্যালঘু। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি মাত্র ১৯৩ ভোটে হেরে গিয়েছিলেন, সেই ভারতীয় বংশোদ্ভুত নেতা বেভেল রামকলাবনের দল স্যেশেলস ন্যাশনাল পার্টিই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ। দু’পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ভারত-স্যেশেলস চুক্তিতে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়। ড্যানি ফরে এবং বেভেল রামকলাবন, দু’জনেই চুক্তির শর্তাবলীকে সবুজ সঙ্কেত দেন। তার পর ২২ জানুয়ারি ক্যাবিনেট সিলমোহর দেয় চুক্তির প্রস্তাবে। ভারতের বিদেশ সচিব এস জয়শঙ্কর স্যেশেলসের রাজধানী ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে ২৭ জানুয়ারি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। প্রেসিডেন্টের দল পিপলস পার্টি এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল স্যেশেলস ন্যাশনাল পার্টি— উভয়েই এই চুক্তির পক্ষে থাকায়, একটি ভোটও এই চুক্তির বিপক্ষে যাবে না বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ ৩৩ আসনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ১৯টি বিরোধী নেতা রমকলাবনের দলের দখলে, ১৪টি প্রেসিডেন্ট ড্যানি ফরের দলের দখলে।

চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, স্যেশেলসের এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন বা নিজস্ব অর্থনৈতিক জলসীমাকে সুরক্ষিত রাখতে এবং জলদস্যুদের দমন করতে ভারত ও স্যেশেলস যৌথ ভাবে কাজ করবে। ২০১৬-র মার্চেই স্যেশেলসে ভারত কোস্টাল সার্ভিল্যান্স রাডার সিস্টেম চালু করেছে বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে। স্যেশেলসের সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভারত সক্রিয় বলে জয়শঙ্কর জানিয়েছেন।

বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, আফ্রিকা উপকূলের কাছে অ্যাসাম্পশন আইল্যান্ডে ভারত সামরিক পরিকাঠামো বৃদ্ধি করবে। ওই দ্বীপে ভারতীয় নৌসেনার উপস্থিতি এবং নজরদারিতে স্যেশেলসের আউটার আইল্যান্ডস অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার হবে এবং সমগ্র দ্বীপরাষ্ট্রের জলসীমা আগের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত হবে বলে নয়াদিল্লি এবং ভিক্টোরিয়া মনে করছে।

ভারত মহাসাগরের যে অংশে স্যেশেলসের অবস্থান, কৌশলগত ভাবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মনে করেন সমর বিশারদরা। ছবি: এএফপি।

প্রেসিডেন্ট ড্যানি ফরে বলেছেন, ‘‘এই প্রকল্প স্যেশেলসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই দুই দেশের মধ্যে যে আত্মীয়তা এবং ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, এই চুক্তি তারই প্রমাণ।’’ প্রেসিডেন্ট ফরে আরও বলেছেন, ‘‘আমাদের উন্নয়নের আকাঙ্খা পূরণের জন্য ভারতকে সহযোগী হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত।’’

আরও পড়ুন: প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্যালেস্তাইন যাচ্ছেন মোদী

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্যেশেলসের জন্য শুধু নয়, এই চুক্তি ভারতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারত মহাসাগরে সামরিক উপস্থিতি দ্রুত বাড়াচ্ছে চিন। ভারতকে ঘিরে বিভিন্ন দেশে বন্দর এবং পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে তারা। ভারতও কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ করেছে, দেশের বাইরে তথা ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন অংশে সামরিক উপস্থিতি ভারত বাড়িয়েছে। কিন্তু কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হর্ন অব আফ্রিকায় চিন পুরোদস্তুর সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে ২০১৭ সালেই। এ খবর ভারতের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক ছিল না। ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে বড়সড় সামরিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা দিল্লির জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। অবশেষে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েই গেল সেই লক্ষ্যে। আফ্রিকায় গড়ে ওঠা চিনা ঘাঁটি জিবুটি থেকে ২৪৫৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত অ্যাসাম্পশন আইল্যান্ডে পুরোদস্তুর সামরিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার ছাড়পত্র পেয়ে গেল ভারত। এই চুক্তি কিন্তু চিনের রক্তচাপ বাড়াবে। মনে করছেন সমর বিশারদরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE