ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দিশাহারা এক মহিলা। ইতালির আমাত্রিসে। ছবি: এএফপি।
এক বছর আগের কথা। ইতালির সব চেয়ে সুন্দর শহরের খেতাব জিতেছিল আমাত্রিস। তিরিশ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেল ছবির মতো সুন্দর সেই শহর।
বুধবার ভোররাতে জো়রালো কম্পন অনুভূত হয় মধ্য ইতালিতে। আর তার জেরে মৃত্যু হয়েছে ২৪৭ জনের। প্রশাসন জানাচ্ছে, আহত প্রচুর। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা। ধ্বংসস্তূপের তলায় রাত পর্যন্ত আটকে বহু মানুষ।
বুধবার ভোর রাত তিনটে বেজে ছত্রিশ মিনিট। তখনও ঘুমে কাদা আমাত্রিস, পেসকারা দেল ত্রন্তো, অ্যাকুমোলির মতো পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ছোট ছোট শহরগুলো। আচমকাই খুব জোর কাঁপুনি। ঘুম ভেঙে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাড়ি-ঘর। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ জানাচ্ছে, তিরিশ সেকেন্ডেরও বেশি সময় ধরে চলা ওই কম্পনের মাত্রা ছিল ৬.২। উৎসস্থল, দক্ষিণ পূর্বের আমব্রিয়া এলাকার নর্সিয়া শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। ইতালির নিজস্ব সংস্থা আইএনজিভি অবশ্য জানাচ্ছে, আজকের ভূমিকম্পের উৎসস্থল হচ্ছে নর্সিয়া থেকে আরও দক্ষিণে অ্যাকুমলি আর আমাত্রিসের কাছাকাছি কোনও এক এলাকায়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬। তবে একটা বিষয়ে দুই সংস্থাই একমত। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার নীচেই ছিল কম্পনের মূল উৎসস্থল। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই জন্যই পাহাড় ঘেরা শহরগুলোয় এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আজ।
এমনিতেই ইতালি ইউরোপের অন্যতম কম্পনপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য এখানে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। ২০০৯ সালে মধ্য ইতালিরই লাকিলায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় তিনশো জনের। আজকের কম্পন সাত বছর আগেকার সেই স্মৃতিই ফিরিয়ে এনেছে। কম্পনস্থলও ওই শহরের আশেপাশে।
আমব্রিয়া, লাজিও আর মার্সে। মূলত এই তিন পার্বত্য এলাকাতেই সব চেয়ে বেশি কম্পন অনুভূত হয়েছে আজ। সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই তিন এলাকারই তিন শহর— আমাত্রিস, অ্যাকুমোলি ও পেসকারা দেল ত্রন্তো।
এর মধ্যে আমাত্রিসের এখন প্রায় ভগ্নপ্রায় অবস্থা। কাল রাতেও যে শহর নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গিয়েছিল, আজ ভোর থেকেই সেখানে হাহাকার আর আর্ত চিৎকার। শহরের মেয়র সের্গিও পিরোজি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁর শহরের বেশির ভাগটাই এখন অতীত। তাঁর কথায়, ‘‘এখন আমাদের কাজ হচ্ছে যত বেশি মানুষকে ধ্বংসস্তূপ থেকে খুঁজে বার করা। আমরা এখনও ভিতর থেকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।’’ উদ্ধারকারীরা জানাচ্ছেন, ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা লোকেদের মোবাইলে ফোন করছেন তাঁরা। যাঁরা ফোন তুলছেন, আগে তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। আমাত্রিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালটি রাস্তায় নেমে এসেছে। গোটা হাসপাতাল ভবনই এখন একটা ধ্বংসস্তূপ। বেশির ভাগ আহতের চিকিৎসা রাস্তাতেই হচ্ছে।
একই ছবি অ্যাকুমোলি শহরেরও। ১৭টি ছোট জনপদ দিয়ে তৈরি এই শহরও কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মেয়র স্তেফানো পেতরুচ্চি জানালেন, অ্যাকুমোলিতে ২৫০০ বাসিন্দা গৃহহীন। চোখের সামনে ছেলে, পুত্রবধূ ও দুই নাতিকে মরতে দেখেছেন এক বৃদ্ধা। উদ্ধারকারীরা যখন তাঁর ন’মাসের ছোট নাতির দেহটি কম্বলে জড়িয়ে মর্গে যাচ্ছেন, বিড়বিড় করে তিনি বললেন, ‘‘ঈশ্বর এক সঙ্গে সকলকে নিয়ে নিলেন!’’
আসন্ন বিদেশ সফর বাতিল করেছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেঞ্জি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কেউ নিজেকে একা মনে করবেননা। আমরা সকলে মিলে এর মোকাবিলা করব।’’ আজ সব অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। তাঁর কথায়, ‘‘এত মৃত্যু, বিশেষত শিশুদের, বড়ই বেদনাদায়ক।’’
মধ্য ইতালির এই সব ছোট ছোট শহরের জনসংখ্যা এমনিতে কম। কিন্তু বছরের এই সময়টা স্থানীয় উৎসবের জন্য কয়েক দিন দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক এসে ভিড় জমিয়েছেন। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ টুইটারে জানান, মৃত বা আহতদের মধ্যে কোনও ভারতীয় নেই।
কম্পন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে উৎস থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে রোমের বাসিন্দারাও কাঁপুনি টের পেয়েছেন। রোমের বাসিন্দা সংযুক্তা দাশগুপ্ত প্রেয়ার আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘রাত সাড়ে তিনটে হবে। খাটটা কাঁপতে শুরু করেছিল। তার পরেই উপরের তলার ফ্ল্যাট থেকে জিনিসপত্র পড়তে শুরু করে। বেশ কিছু ক্ষণ চলে দুলুনিটা।’’
আরও পড়ুন...
তীব্র ভূকম্প মায়ানমারে, কাঁপল পড়শি দেশগুলিও
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy