ছেলেটাকে সিড বলেই চিনত সবাই। ঠাট্টা করতে ভালবাসত, চুলে জেল লাগাত, আর্সেনাল-ভক্ত কিশোরটি গান শুনত নির্বাণা-র। বান্ধবীদের নিয়ে মার্কিন অ্যাকশন ছবি দেখতে যেত। মানে ওই বয়সে আর পাঁচটা কিশোর যা যা করে থাকে আর কী!
সেই সিড অর্থাৎ সিদ্ধার্থ ধর কবে আইএস জঙ্গি আবু রুমায়েশ হয়ে গেল? বোন কণিকার কাছে এখনও ধাঁধা। উত্তর লন্ডনের বাসিন্দা বছর ২৩-এর আইনের এই ছাত্রীর কথায়, ‘‘সিদ্ধার্থ ধরকে ভুলে গিয়েছে দাদা। আইএস জঙ্গির সত্তাটাই এখন সত্যি।’’ সিদ্ধার্থ সিরিয়ায় পাড়ি দেওয়ার পরে একটি সংবাদপত্রে এমনটাই দাবি করেছেন কণিকা। জানান, বাবার মৃত্যুর পরে দাদা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল। তখনই বোধহয় সিদ্ধার্থের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আবু রুমায়েশ প্রকট হয়ে ওঠে, মন্তব্য কণিকার।
পিতৃবিয়োগের সময়ে সিদ্ধার্থের বয়স ছিল ১৬। কণিকা জানালেন, শৈশবে বাবা-মার সঙ্গে তিন ভাই-বোন লন্ডন চলে এসেছিলেন। শহরের উত্তরে পামার্স গ্রিনে থাকতেন। ওই অঞ্চলে সাধারণত ভারত, পাকিস্তান, গ্রিস বা সাইপ্রাস থেকে আসা অভিবাসীদের বাস। কণিকার দাবি, তাঁর পরিবার হিন্দু-ভারতীয় ও ব্রিটিশ— দুই সংস্কৃতিই আপন করেছিল। দীপাবলির মতো বড়দিনও পালিত হতো।
কিন্তু সব বদলে যায় বাবার মৃত্যুর পর।
কণিকার কথায়, ‘‘মাত্র ৪৬ বছরে চলে গেলেন বাবা। মা (সবিতা ধর) তার পর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আমি আর আমার আর এক দিদি কাছাকাছি ছিলাম। কিন্তু একা হয়ে গেল সিড। বাড়িতে তখন ও-ই একা ছেলে।’’ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধার্থ তখন অনেকটাই অপরিণত। ‘‘ও কখনও কারও সাহায্য চায়নি। কিন্তু এখন মনে হয়, ওকে পথ দেখানোর কেউ থাকলে ভাল হতো। কিন্তু তেমন কেউ তখন ছিল না,’’ মন্তব্য কণিকার।
‘‘ধীরে ধীরে সিডের পড়াশোনায় এ সবের প্রভাব পড়ছিল। সিড আরও চুপচাপ হয়ে যায়। তার পরে কোনও মতে হাইস্কুল টপকায়।’’— এই কথা বলেই কণিকা মনে করাচ্ছেন তত দিনে সিদ্ধার্থর দন্ত চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন উধাও। একটা ফার্মাসি দোকানে কেরানির চাকরি জোটান দাদা।
জঙ্গি-যোগের সূত্র মেলে আরও পরে। কণিকা জানাচ্ছেন, এই সঙ্কটের সময় এক বন্ধু পাশে ছিল সিদ্ধার্থের। যার নাম মিজানুর রহমান। কণিকাদের পড়শি এলাকাতেই থাকত সে। বাংলাদেশের অভিবাসী। আট বছর থেকে ওদের বন্ধুত্ব। দু’জনে দু’জনকে ডাকত সিড আর মিজ বলে। সিদ্ধার্থের জন্মদিনে আসত মিজ। বাস্কেটবল খেলা, ভিডিওগেম সবই চলত।
লন্ডনের অন্যতম কট্টরপন্থী মুসলিম ধর্মগুরু ওমর বকরি মহম্মদ ছিল মিজানুরের আদর্শ। বকরি আবার আল কায়দার ঘনিষ্ঠ। ব্রিটেনে দু’টি জঙ্গি গোষ্ঠীকে মদত দিত। দু’টি গোষ্ঠীই পরে নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ
সরকার। মিজের সঙ্গেই বকরির কাছে যেত সিড। বকরির কথাবার্তা শুনে প্রভাবিত হয়ে এরই একটি গোষ্ঠী আল মুহাজিরৌনে যোগ দেয় সিদ্ধার্থ। কণিকার কথায়, ‘‘দেখলাম, তখন দাদা আর মায়ের রান্না খাচ্ছে না। বলছে, অমুসলিমের রান্না খাব না। গান শোনা-টিভি দেখা বন্ধ। মাটিতে শোয়া শুরু করেছিল। বলত, হজরত মহম্মদের মতো সাধারণ জীবনযাপনের চেষ্টা করছি।’’
তখনও কিন্তু ধর্মান্তরণ করেনি সিড। ২০০২ সালের একটা সন্ধে। পরিবারের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেল ১৯ বছরের ছেলেটি। বন্ধুদের তত্ত্বাবধানে ইসলামে দীক্ষা। নাম হল সইফ আল ইসলাম (ইসলামের তরোয়াল)। প্রথমে ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়টি গোপন রেখেছিল। দু’সপ্তাহের মধ্যেই প্যালেস্তাইনের সমর্থনে এক প্রতিবাদ-মিছিলে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হয়। মা সবিতা থানা থেকে ছেলেকে নিতে এসে জানতে পারেন, সে ধর্ম পাল্টেছে।
চার বছর পরে সিদ্ধার্থের ইচ্ছে মতোই বন্ধুরা জোগাড় করে দিয়েছিল গোঁড়া মুসলিম বৌ। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণী আয়েশার সঙ্গে জীবনের আর এক পর্ব শুরু। সিদ্ধার্থ স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায় পূর্ব লন্ডনের ওয়ালদামস্টো-এ, যেখানে মূলত কট্টর মুসলিমদের বাস। কণিকার কথায়, ‘‘সিডের বয়সি আয়েশাকে আধুনিকা মনে হলেও বোরখা পরতে দেখেছি।’’ দু’বছর পরে সিদ্ধার্থ-আয়েশার প্রথম কন্যাসন্তান রুমায়েশের জন্ম। এই সময় থেকেই সিদ্ধার্থ হলেন আবু রুমায়েশ, (অর্থাৎ রুমায়েশের বাবা)। পরের সন্তানের নামকরণ হল ওসামা বিন লাদেনের নামে, উসামা। তার পরে পাঁচ সন্তানের বাবা-মা আবু-আয়েশার সিরিয়া পাড়ির গল্পটাই এখন মুখে মুখে ফিরছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy