Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
International News

নিজের ভাই নয়, কান্দিল বালোচকে শ্বাসরোধ করে মেরেছিল তুতো ভাই

পরিবারের অনেকেই যে কান্দিল বালোচ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি বা পরোক্ষে যুক্ত, তা এত দিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে পাকিস্তান পুলিশের কাছে। এ বার পলিগ্রাফ টেস্ট বা লাই ডিটেক্টরে উঠে এল নতুন ‘তথ্যপ্রমাণ’।

সংবাদ সংস্থা
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ১৬:০১
Share: Save:

পরিবারের অনেকেই যে কান্দিল বালোচ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি বা পরোক্ষে যুক্ত, তা এত দিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে পাকিস্তান পুলিশের কাছে। এ বার পলিগ্রাফ টেস্ট বা লাই ডিটেক্টরে উঠে এল নতুন ‘তথ্যপ্রমাণ’। কান্দিলের নিজের ভাই এবং এই হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত মহম্মদ ওয়াসিম প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিলেন, তিনিই দিদিকে শ্বাস রোধ করে মেরেছেন। এই খুনের জন্য তিনি যে এতটুকু অনুতপ্ত নন, তাও বলেছেন ওয়াসিম। কিন্তু ওয়াসিম এবং আর এক অভিযুক্ত হক নওয়াজের পলিগ্রাফ টেস্টে ধরা পড়ল, সেই বয়ান ঠিক নয়। কান্দিলকে ওষুধ দিয়ে আচ্ছন্ন করার পর ওয়াসিম তাঁর হাত, পা চেপে ধরেছিলেন। আর শ্বাস রোধ করে খুন করেন কান্দিলের তুতো ভাই হক নওয়াজ।

গত ১৫ জুলাই রাতে মুলতানে নিজের বাড়িতেই খুন হন পাক মডেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি কান্দিল বালোচ। খুনের পর কান্দিলের ভাই মহম্মদ ওয়াসিমের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন বাবা মহম্মদ আজিম। গ্রেফতারের পর ওয়াসিম খুনের কথা স্বীকার করেন। পারিবারিক ‘সম্মান’ রক্ষা করতেই এই খুন বলে তিনি জানান। কিন্তু তদন্তে নেমে পুলিশ বুঝতে পারে একা ওয়াসিম নন, এই হত্যাকাণ্ডে আরও কেউ কেউ জড়িত।

তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, হঠাত্ ঝোঁকের মাথায় করে ফেলা খুন এটা নয়। যথেষ্ট ভেবেচিন্তে, পরিকল্পনা করেই যে কান্দিলকে মারা হয়েছিল তা পুলিশ নিশ্চিত। পুলিশ তদন্তে উঠে এসেছে, খুনের আগে শুধু কান্দিলকেই নয়, ওষুধ দিয়ে বেহুঁশ করে ফেলা হয়েছিল তাঁর বাবা, মাকেও। তদন্তে উঠে এসেছে, কান্দিলের বড় ভাই, সৌদি আরব প্রবাসী আরিফ, কান্দিলকে খুন করে ফেলার জন্য বারবার উস্কে গেছেন ভাই ওয়াসিমকে। কান্দিলের বোন শাহনাজ এবং তুতো ভাই হক নওয়াজও এই খুনে জড়িত বলে জানতে পারে পুলিশ। শাহনাজ এবং হককে দিন কয়েক আগে গ্রেফতারও করা হয়। তবে তদন্তকারীদের মতে, খুনের মূল পরিকল্পনাটা করেছিলেন ওয়াসিম এবং হক- এই দু’জনে মিলেই।

পুলিশি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ নেই পাকিস্তানের প্রথম সারির ধর্মগুরু মুফতি আবদুল কাভি। এই ধর্মগুরুর সঙ্গে কান্দিলের সেলফি পোস্ট করে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছিলেন কান্দিল। রমজান চলাকালীন করাচির এক হোটেলের ঘরে তোলা এই ছবি পোস্ট হতেই সমালোচনার তুমুল ঝড় ওঠে। একটি ছবিতে ওই ধর্মীয় নেতার টুপিও মাথায় দিয়ে ছিলেন কান্দিল। আবদুল কাভির কোলে বসা ছবিও পোস্ট করেছিলেন তিনি। তুমুল বিতর্কের জেরে ওই ধর্মীয় নেতাকে ইদের চাঁদ দেখার কমিটি থেকে বরখাস্ত করে পাকিস্তান সরকার। কাভি সাফাই দেন, ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতেই তিনি কান্দিলের কাছে গিয়েছিলেন।

কিন্তু কান্দিল এখানেও থেমে থাকেননি। সোশ্যাল সাইটে লেখেন, ‘‘মুফতি কী করে নিজেকে ইসলামের অভিভাবক বলেন? উনি তো ইসলামের নামে কলঙ্ক। উনি অনুরাগীদের সামনে এক রকম, আলাদা থাকলে আর এক রকম। একটি টিভি শোয়ের প্যানেলে আমাদের আলাপ হয়েছিল। সেখানে আমার ফোন নম্বর আলাদা করে চেয়েছিলেন। আমার সঙ্গে একেবারেই সম্মানজনক ব্যবহার করেননি। ফলে এই লোকটাকে আমি এক্সপোজ করতেই চেয়েছিলাম।’’

পরের অংশ পড়তে ২ ক্লিক করুন

এই ধর্মগুরু মুফতি আবদুল কাভিকেও সন্দেহের আওতায় রেখেছে পুলিশ। কান্দিলের মা আনোয়ার আজিমও অভিযোগ করেছেন, খুনের পিছনে মুফতির উস্কানি ছিল। পুলিশ ইতিমধ্যেই মুফতির লিখিত জবানবন্দি নিয়েছে।

মুফতিকে ঘিরেই প্রথম বিতর্কে জড়াননি কান্দিল। বরং ২৬ বছর বয়সে পরিবারের লোকজনের হাতে খুন হওয়া এই মডেল গত কয়েক বছর ধরে বারবার আলোচনায় এসেছেন সংবাদ মাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়। পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজ বা পরিবারের মধ্যে থেকেও খুবই খোলামেলা এবং তোয়াক্কা না করা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন কান্দিল। নিজের নগ্নতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা করতেও পিছ পা ছিলেন না। যৌনতা বা নগ্নতা নিয়ে তাঁর খোলামেলা কথাবার্তা নিয়ে বিতর্কেও পড়েছেন বারবার। কিন্তু নিজের অবস্থানে অটল থেকে গোটা ব্যাপারটাকে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে এক জন মেয়ে হিসাবে নিজের লড়াই বলেই দেখাতে চেয়েছেন।

গত ১৫ জুলাই, খুন হওয়ার দিনেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটি ছবি পোস্ট করে কান্দিল লিখেছিলেন, “কত বার আমাকে টেনে নামানো হবে তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না, আমি কিন্তু একজন যোদ্ধা এবং আমি উঠে দাঁড়াবোই”।

খুন হওয়ার আগের দিন কান্দিল পোস্ট করেছিলেন, “একজন মেয়ে হিসেবে আমাদের নিজেদের হয়েই উঠে দাঁড়াতে হবে... মেয়ে হিসেবে আমাদের একজনের পাশে অন্যজনকে দাঁড়াতে হবে... মেয়ে হিসেবে আমাদের সুবিচারের জন্য লড়াই করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি আমি একজন আধুনিক সময়ের নারীবাদী। আমি সমান অধিকারে বিশ্বাস করি। মেয়েদের কেমন হওয়া উচিত এটা আমরা ঠিক করে দিতে পারি না। শুধু সমাজের কথা ভেবে নিজেদের পরিচয়ে তকমা লাগানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না। আমি শুধুমাত্র একজন মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত মনের নারী এবং আমি যেমন আমি তেমন থাকতেই ভালবাসি”।

বলা বাহুল্য, যে কোনও রক্ষণশীল সমাজই একজন মেয়ের লেখা এই সব কথাকে ভাল ভাবে নেয় না। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার এক দিকে যেমন বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি (তাঁর টুইটার ফলোয়ার ৪০ হাজার, ফেসবুক ফলোয়ার সাত লক্ষের বেশি) তেমনই বিতর্ক, নিন্দা, সমালোচনা পিছু পিছু চলেছে তাঁর।

এই ছিলেন কান্দিল। কখনও প্রিয় ক্রিকেটারকে খোলা পোস্টে প্রেম নিবেদন করে তাঁর জন্য নগ্ন নাচ দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কখনও বিখ্যাত ধর্মগুরুর ‘চরিত্র এক্সপোজ’ করেন। এ হেন চরিত্র সমাজে, পরিবারে অনেকেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে সন্দেহ নেই। খুন হতে পারেন বলে আশঙ্কাও করেছিলেন তিনি। কারণ কান্দিল তো জানতেন, তাঁর দেশ পাকিস্তানে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ‘অনার কিলিং’এর ঘটনা ঘটে। ‘সম্মানের জন্য’ খুন হওয়াদের অধিকাংশই যে মেয়ে তাও বলাই বাহুল্য। কান্দিল পুলিশকেও জানিয়েছিলেন নিজের আশঙ্কার কথা। নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ‘অনার কিলিং’এর শিকার হতে হল তাঁকেও।

কান্দিল খুনের পর আশার কথা একটাই। প্রবল নড়াচড়া পড়েছে পাকিস্তান জুড়ে। এত দিন ‘পারিবারিক ক্ষমা’র মতো আইনি ফাঁক গলে এই সব ‘সম্মান রক্ষাকারী’ খুনিরা অনেকেই শাস্তি এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এ বার কড়া আইনের কথা ভাবছে পাকিস্তানের সরকার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সেটা চাইছে। এমনকী কান্দিল বালোচ হত্যা মামলায় যে পারিবারিক ক্ষমা প্রদর্শনের কোনও সুযোগ দেওয়া হবে না, তাও পরিষ্কার করে দিয়েছে পাকিস্তান পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Qandeel Baloch Pakistan Model
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE