Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
উদ্বাস্তু-সঙ্কটে বাড়ছে উদ্বেগ

হাত ফস্কে সমুদ্রে পড়ে গেল বাচ্চা দু’টো! হাহাকার বাবার

তখন নিকষ অন্ধকার। বিশাল বিশাল ঢেউ উঠছিল সমুদ্রে। ডিঙিটা দুলছিল বিপজ্জনক ভাবে। যাত্রী আবদুল্লা কুর্দি হঠাৎ দেখেছিলেন, হাল ধরে থাকা লোকটা জলে ঝাঁপ দিল।

এ ভাবেই পড়েছিল ছোট্ট আয়লানের দেহ। ছবি: এএফপি।

এ ভাবেই পড়েছিল ছোট্ট আয়লানের দেহ। ছবি: এএফপি।

সংবাদ সংস্থা
ইস্তানবুল শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:০০
Share: Save:

তখন নিকষ অন্ধকার। বিশাল বিশাল ঢেউ উঠছিল সমুদ্রে। ডিঙিটা দুলছিল বিপজ্জনক ভাবে। যাত্রী আবদুল্লা কুর্দি হঠাৎ দেখেছিলেন, হাল ধরে থাকা লোকটা জলে ঝাঁপ দিল।

আবদুল্লা বুঝেছিলেন, নৌকো ডুবছে। সঙ্গে স্ত্রী এবং তিন ও পাঁচ বছরের দুই ছেলে। আরও অন্তত জনা তেরো যাত্রী নৌকোয়। আবদুল্লা চেষ্টা করলেন হাল ধরার। তবু নৌকো উল্টোল। আর তখন স্ত্রীর হাতটা শক্ত করে ধরতে ধরতে আবদুল্লা দেখলেন, হাতের ফাঁক গলে তাঁর বাচ্চা দু’টো পড়ে গেল ওই উথালপাথাল সমুদ্রে।

পরিবারের সঙ্গে সেই শেষ দেখা আবদুল্লার। দিনের আলো ফুটলে তাঁর ছোট ছেলের একরত্তি দেহটা ভেসে এসেছিল তুরস্কের বদরামের সমুদ্রসৈকতে। ভেজা বালির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল তাঁর আদরের আয়লান। লাল জামা, নীল প্যান্ট পরা। পায়ে খুদে খুদে জুতো। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ধুয়ে দিচ্ছিল তার মুখ। এক তুর্কি পুলিশ কোলে তুলে নিয়েছিলেন প্রাণহীন একরত্তি শরীরটাকে।

গত কাল সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নানা ওয়েবসাইটে ছবিটা ছড়িয়ে পড়তেই শিউরে উঠেছে বিশ্ব। আর সেই সঙ্গে উঠে এসেছে বেশ পুরনো একটা প্রশ্নও— আর কত দিন? কেউ প্রাণ দেবে বোমা-গুলিতে, আবার কারও জীবন শেষ হয়ে যাবে নিজের দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে। আর কত দিন যুদ্ধের বলি হবে নিরীহ জীবন? বলি হবে আয়লানের মতো শিশুরা? আয়লান শুধু নয়, তার দাদা গালিপ আর মা-ও মারা গিয়েছে ওই নৌকোডুবিতে। সব হারিয়ে বেঁচে আছেন শুধু আবদুল্লা।

সিরিয়ার কোবানির পরিবারটাকে আচমকাই ‘শরণার্থী’ বানিয়ে দিল যুদ্ধ পরিস্থিতি। কোবানি ছেড়ে প্রথমে দামাস্কাস, আলেপ্পো, সেখান থেকে আবার কোবানি। কিন্তু সিরিয়ায় আইএস জঙ্গি এবং কুর্দ বাহিনীর লড়াইয়ে ছেদ পড়ে না। তাই একেবারেই ছাড়তে হয় ভিটেমাটি। মাসখানেক হল, সপরিবার বদরামে এসেছিলেন আবদুল্লা।

একটা চেষ্টা করছিলেন কানাডায় যাওয়ার। আবদুল্লার বোন টিমা কুর্দি প্রায় কুড়ি বছর ধরে কানাডার বাসিন্দা। টিমা চাইছিলেন, ভাই ও তাঁর পরিবার কানাডাতেই আশ্রয় পাক। কিন্তু তুরস্কে সে রকম শরণার্থী সমস্যা নেই— এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁদের আবেদন বাতিল করে দেয় কানাডা সরকার। শেষে আবদুল্লা ঠিক করেন, সমুদ্র পেরিয়ে যাবেন গ্রিসে।

বদরামের আকাইয়ারলার থেকে সমুদ্র পেরোলেই গ্রিসের কস দ্বীপ। আবদুল্লারা আগে দু’বার চেষ্টা করেছিলেন দালাল ধরে সমুদ্র পেরোতে। দু’বারই ধরা পড়ে যান। এ বার তাই নিজেরাই বন্দোবস্ত করেছিলেন। দু’টো নৌকো মিলিয়ে জনা পঁচিশ মানুষ। গভীর রাতে ভেসেছিল নৌকো দু’টো। দু’টোই ডুবেছে। আবদুল্লাদের নৌকায় ছিল ১৭ জন। অন্যটায় ৬ জন। ঠিক ক’জন বেঁচেছেন, সঠিক হিসেব এখনও নেই।

কী হয়েছিল? এক সাংবাদিক একটু কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। শুধুই ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলেন আবদুল্লা। কোনও মতে বললেন, ‘‘নৌকো ডুবছে দেখেই সারেং জলে লাফ দিল। আমি হাল ধরলাম। কিন্তু আমি কি সামলাতে পারি? স্ত্রীর হাতটা ধরে ছিলাম। বাচ্চাগুলো
হঠাৎ হাত ফস্কে বেরিয়ে গেল। নৌকোও উল্টোল। নৌকোটা ধরে ভেসে থাকতে চাইছিলাম। হাতড়ে হাতড়ে বৌ-ছেলেদের খুঁজেও পেয়েছিলাম। কিন্তু সকলকেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঢেউ। ওদের আবার দেখা পেলাম মর্গে।’’

কানাডায় আজ সকালে ঘুমভাঙানো ফোনে খারাপ খবরটা পেয়েছেন টিমা। আর ক্লান্ত আবদুল্লা ঠিক করেছেন, ‘ঘুমন্ত’ দুই ছেলেকে নিয়ে কোবানিতেই ফিরে যাবেন। বলছেন, ‘‘আর ইউরোপ নয়। ওদের সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Syrian boy Greek island MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE