Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
জঙ্গিরা জলাশয়ে ফেলেছে দেহ, আশঙ্কা

কলমা পড়তে না পারলেই গলায় কোপ

প্রথমে নাম। আর তার পর নির্ভুল উচ্চারণে ধর্মবাক্য পাঠ। না পারলেই গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ! জঙ্গি-তাণ্ডবে রক্তাক্ত গুলশনের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁর অন্দরমহলে গত কাল রাতভর এমনই তাণ্ডব চালাল জঙ্গিরা। এক মুহূর্ত আগের কফি-কুকিজের সপ্তাহান্তের রেস্তোরাঁ মুহূর্তে পাল্টে গিয়েছে দুঃস্বপ্নে! এক বারে আক্ষরিক অর্থেই রে-রে করে এসেছে সাত জঙ্গি।

জঙ্গিদের গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন এই ব্যক্তি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন পথচারীরাই।

জঙ্গিদের গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন এই ব্যক্তি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন পথচারীরাই।

সংবাদ সংস্থা
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৮
Share: Save:

প্রথমে নাম। আর তার পর নির্ভুল উচ্চারণে ধর্মবাক্য পাঠ। না পারলেই গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ!

জঙ্গি-তাণ্ডবে রক্তাক্ত গুলশনের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁর অন্দরমহলে গত কাল রাতভর এমনই তাণ্ডব চালাল জঙ্গিরা। এক মুহূর্ত আগের কফি-কুকিজের সপ্তাহান্তের রেস্তোরাঁ মুহূর্তে পাল্টে গিয়েছে দুঃস্বপ্নে! এক বারে আক্ষরিক অর্থেই রে-রে করে এসেছে সাত জঙ্গি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ঘড়িতে তখন পৌনে ন’টা (ভারতীয় সময়ে ৮টা ১৫)। বোমা-বুলেট-গ্রেনেড-কালাশনিকভ-তরোয়াল উঁচিয়ে ঈশ্বরের নামে চিৎকার করে সেই যুবকেরা পণবন্দি করে ফেলেছে রেস্তোরাঁর জনাচল্লিশ অতিথিকে! আর তার পর একে একে প্রত্যেকের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে যাচাই করেছে তাদের ধর্ম! পড়িয়েছে কলমা। যাঁরা বন্দুকের নলের সামনে নির্ভুল ভাবে কলমা (ধর্মের সারবাক্য) পড়তে পেরেছেন, প্রাণে বেঁচেছেন। আর যাঁরা পারেননি, গলা কেটে খুন করা হয়েছে তাঁদের বেশিরভাগকেই! পণবন্দি করে জঙ্গি হামলার নজির সাম্প্রতিক অতীতে কম নেই। কিন্তু পণবন্দিদের প্রত্যেককে ধরে ধরে এ ভাবে মুণ্ডচ্ছেদের ঘটনা নজিরবিহীন!

গুলশনের ‘হোলি আর্টিজান বেকারি’ তত ক্ষণে বদলে গিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে! খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছলে জঙ্গিরা তাদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। এলাকা খালি করে রেস্তোরাঁ ঘিরে ফেলে পুলিশ। প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, শনিবার রাত পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ২৮-এ। তাঁদের মধ্যে কুড়ি জন বিদেশি।

রেস্তোরাঁর এক কর্মী জানিয়েছেন, পণবন্দিদের ধরে ধরে ধর্মবাক্য (কলমা) পড়তে বলেছিল জঙ্গিরা। বন্দুকের নলের সামনে অনেকেই সেই ধর্মবাক্য পাঠ করেছেন। অনেকে এমনও ছিলেন, যাঁরা মুসলিম হলেও কলমা পড়ার অভ্যাস নেই। কিংবা অস্ত্রের সামনে গলা শুকিয়ে যাওয়ায় একটাও কথা বেরোয়নি মুখ থেকে। রেস্তোরাঁ সংলগ্ন একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের গলা কেটেছে জঙ্গিরা।

মূলত বিদেশিদের নিশানা করেই যে কূটনৈতিক এলাকার রেস্তোরাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে তা স্পষ্ট হয়েছে। কাল রাতে তেরো বছরের মেয়ে সারার জন্মদিন পালন করতে ওই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা হাসনাত করিম এবং তাঁর স্ত্রী শর্মিন।

সঙ্গে ছিল তাঁদের আট বছরের ছেলে রায়ানও। হামলার খবর ছড়িয়ে পড়তেই রেস্তোরাঁর বাইরে ভিড় করেন পণবন্দিদের আত্মীয়-বন্ধুরা। রাতভর সেখানেই অপেক্ষা করেন তাঁরা। সকাল সাতটা পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষা করেও পুলিশের কাছে কোনও তথ্য না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা। তবে পুলিশি তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে

আসে। সেই ভিড়ের মধ্যে ছিলেন হাসনাতের বাবা রেজাউল করিমও। পরিবারের সকলে ভাল আছে জানার পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিল ওরা। তাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করেছিল। যারা ধর্মবাক্য পড়তে পেরেছিল তাদের ওরা কিচ্ছু করেনি।’’

ছেলে ওই রেস্তোরাঁয় আটকে রয়েছে জানতে পেরে গুলশনে ছুটে গিয়েছিলেন শাহরিয়ার খান। খোঁজ পাননি রাতভর। সকাল আটটা নাগাদ ছেলে নিজেই ফোন করে তাঁকে সুস্থ থাকার খবর জানান। শৌচালয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন রেস্তোরাঁর রাঁধুনি সমীর রায়। সঙ্গে ছিল তাঁর ভাগ্নে রিন্টুও। রাতভর টেক্সট মেসেজে ভাই গোপালের সঙ্গে কথা চালাচালি হয় সমীরের। জানান, তাঁরা সুস্থ আছেন। পুলিশ কী ভাবে দেওয়াল ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে, সে কথা জানান গোপালও। সকালে রিন্টুকে উদ্ধার করা হলেও সমীরের খোঁজ মেলেনি।


হামলার পর রেস্তোরাঁর পাশের জলাশয়ে টহল দিচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। শনিবার।

বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে কলমা-পাঠের সময় জঙ্গিদের চোখে ধুলো দিয়ে কোনও রকমে পালিয়ে গিয়েছিলেন দু’জন। তাঁদের এক জন রেস্তোরাঁরই কর্মী। ছাদ থেকে লাফিয়ে পালাতে গিয়ে নর্দমায় পড়ে যান তাঁরা। তবে টুঁ শব্দটি করেননি রাতভর। ঘণ্টা সাতেক পরে, আজ সকালে পুলিশ এসে উদ্ধার করেছে দু’জনকেই।

স্থানীয় বাসিন্দা, প্রত্যক্ষদর্শী এমনকী পুলিশেরও কেউ কেউ আড়ালে আশঙ্কা করেছেন, খুন করে রেস্তোরাঁর কোলঘেঁষা বিস্তীর্ণ জলাশয়ে অনেকের দেহ ফেলেছে জঙ্গিরা। যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সে সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের যুক্তি, ওই জলাশয়ে নৌ কম্যান্ডো নামানো হয়েছিল। রাতভর চলেছে টহলদারি। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে কাউকে জলে ফেলা হলে তা নজরে পড়ত বলেই দাবি সেনার।

ভারতীয় সময় সকাল ৬ টা ৪০ থেকে অভিযান শুরু করে কম্যান্ডো বাহিনী। পৌনে ন’টা নাগাদ পণবন্দিদের ১৩ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হয় গলার নলিকাটা ২০টি দেহ। খতম ছয় হামলাকারীও। এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে আছে মৃতদেহ। রক্তবন্যা বইছে।’’

লড়াই শেষ হয়েছে, মারা পড়েছে হামলাকারীরাও। কিন্তু কমেনি আতঙ্ক। বিশ্ব জুড়ে জঙ্গি হামলার নজিরগুলো বলে দিচ্ছে, ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানে বার বারই আম জনতাকে পণবন্দি করে খুন করেছে জঙ্গিরা। ২৬/১১-র মুম্বই, ১৩/১১-র প্যারিস থেকে সিডনির কাফে কিংবা জাকার্তার কফিশপ— নজির কম নয়। সন্ত্রাসের সেই মানচিত্রে এ বার মিলে গিয়েছে ঢাকাও। তবে ধরে ধরে এমন নৃশংস ভাবে গলা কাটার ঘটনায় নজিরবিহীন। শুধু বাংলাদেশই নয়, এমন ভয়ানক গণহত্যায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে তামাম বিশ্ব।

ছবি: রয়টার্স।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kalma terrorist Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE