Advertisement
১৯ মে ২০২৪

রঙিন গ্যালারি, বর্ণহীন মাঠ, হতাশাতেও যে আবির ওড়ে দেখাল ডার্বি

কাঞ্চনজঙ্ঘার ঈশান কোণে ম্যাচ শেষে মুঠোমুঠো সবুজ-মেরুন আবির উড়িয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সনি নর্ডির দলের সমর্থকরা। বাকি মাঠেও এক ছবি। সেখানে জ্বলল কাগজের মশাল। লাল-হলুদ আবির।

হঠাৎ গোলমাল। শিলিগুড়িতে রবিবাসরীয় ডার্বি। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

হঠাৎ গোলমাল। শিলিগুড়িতে রবিবাসরীয় ডার্বি। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

রতন চক্রবর্তী
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৫২
Share: Save:

ইস্টবেঙ্গল-০

মোহনবাগান-০

কাঞ্চনজঙ্ঘার ঈশান কোণে ম্যাচ শেষে মুঠোমুঠো সবুজ-মেরুন আবির উড়িয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সনি নর্ডির দলের সমর্থকরা।

বাকি মাঠেও এক ছবি। সেখানে জ্বলল কাগজের মশাল। লাল-হলুদ আবির।

কোনওটাই অবশ্য আনন্দে নয়। বরং হতাশা আর বঞ্চনার প্রতীক মনে হচ্ছিল শিলিগুড়ির গ্যালারিকে।

সমর্থকদের আসা শুরু হয়েছিল সকাল থেকেই। কলকাতা এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে ভিড় জমিয়েছিলেন বেঙ্গল-বাগান পাগলরা। কিন্তু আঠাশ হাজারের গ্যালারি ভরিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের কেউই সম্ভবত সঙ্গে করে আনা বিজয়োৎসবের সরঞ্জাম নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে চাননি। তাই বিসর্জন।

এ রকম একটা নির্বিষ, পানসে ম্যাচের স্মৃতিচিহ্ন কেনই বা বয়ে নিয়ে যাবেন বাড়িতে!

ম্যাচের আগে লাল-হলুদ রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে এসে সঞ্জয় সেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গেলেন ট্রেভর জেমস মর্গ্যান। ম্যাচের পরও একই দৃশ্য। দু’জনের মুখেই কী স্বস্তি! কী তৃপ্তি!

অবাক হওয়া গেল এটা দেখে যে, সাংবাদিকদের সামনে এসেও যুযুধান দুই কোচের মুখে জেতার দাবি নেই। নেই কথার ফুলঝুরি। যা বিরলতম ঘটনা হিসাবে থেকে যেতেই পারে ডার্বি ইতিহাসে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ইস্টবেঙ্গল কোচের মুখ থেকে বেরোল, ‘‘জিতলে ভাল লাগত। জিততাম বলছি না। তবে কষ্টার্জিত পয়েন্ট পেলাম একটা।’’ কী আশ্চর্য বাগান কোচের গলাতেও কোনও আক্ষেপ বা আফসোস নেই। ‘‘ওরাই চাপে ছিল। একটা গোলের সুযোগ পেয়েছিল ওরা। এডুর ভুলে। ম্যাচটা জিততে পারতাম এই দাবি করছি না।’’

করবেনই বা কী করে? পেশাদারদের জমানায় বাঙালি আবেগের চিরকালীন যুদ্ধের আবহ যে অঙ্কের খেলায় এখন বন্দি। তার রেশ এতটাই যে, সাইড ব্যাকদের এগোনোর গণ্ডি বেঁধে দেওয়া হয়। স্ট্রাইকারদেরও প্রয়োজন মতো রক্ষণে নামিয়ে এনে গোল আটকানোর স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা হয়।

খেতাব জেতার লক্ষ্যে চল্লিশ ভাগ দৌড়ও এখনও শেষ হয়নি, ডার্বি হারার ঝুঁকি কে-ই বা নেয়? মর্গ্যান বা সঞ্জয় তাই বাঁচার পথই বেছে নিয়েছেন। এ বারের আই লিগের প্রথম ডার্বি তাই মাঠের বাইরে গত কয়েক দিন ধরে যে ভাবে গর্জাল, বর্ষণ তেমন হল না। জিততে না পারলে সমর্থকরা তো হতাশ হবেনই। আফসোস করতে করতে বাড়িও ফিরবেন। এটাই স্বাভাবিক। কে আর ‘চশমা’ ফল দেখে খুশি হয়।

ইস্টবেঙ্গল এক নম্বরে, বাগান দু’নম্বরে। খেতাবের লড়াইয়ে থাকা বেঙ্গালুরু পয়েন্ট নষ্ট করছে নাগাড়ে। এই অবস্থায় দু’দলের পয়েন্ট ভাগ খেতাবের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কতটা প্রভাব ফেলবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে টুর্নামেন্টের শেষ দিন পর্যন্ত। ভাইচুং ভূটিয়া সেটা বলেও গেলেন ম্যাচের পর। ‘‘এই ফলে বেঙ্গালুরুর কিছুটা সুবিধা হল বলেই মনে হচ্ছে ’’ বলছিলেন পাহাড়ি বিছে।

আরও পড়ুন।

পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে ফের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত

কী পেলাম ম্যাচটা থেকে?

বিদেশিদের মার্কশিট তৈরি করতে বসলে বাগানের এডুয়ার্ডো আর ইস্টবেঙ্গলের ওয়েডসন ছাড়া বাকিরা কেউ পাস মার্ক পাবেন না অন্তত এই ম্যাচে।

সনি নর্ডি? বাগানের হার্টথ্রব! খেলার ইচ্ছেটাই নেই মনে হল। চোট সারিয়ে ফিরেছেন ঠিক আছে। কিন্তু চারটে ডার্বি খেলে ফেললেন হাইতির এই ফুটবলার, একটা গোল নেই এখনও। জোসে ব্যারেটোর সঙ্গে তাঁকে তুলনা করব কী ভাবে? তারকা হতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের রং বদলের কুশীলব হতে হয়। সনি এখনও সেটা হয়ে উঠতে পারেননি বাগানে। তা তাঁকে নিয়ে যতই হইচই হোক। কাতসুমি আর ডাফিরও এক হাল। ইস্টবেঙ্গলের উইলিস প্লাজা? ওয়ান টু ওয়ান অবস্থায় গোল করতে ব্যর্থ। বাকি সময়টা তো হাঁটলেন! খুঁজেই পাওয়া গেল না। আর বুকেনিয়া? শরীরটা ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে আটকানোর কৌশলই তাঁর পছন্দ। এমনিতে মন্থর। ছোট চেহারার বাগান স্ট্রাইকার জেজেকে তিনি রুখলেন বটে, বাগান কোচ আগে বলবন্ত সিংহকে নামালে খাবি খেতেন উগান্ডার এই ডিফেন্ডার। এখনও তিনি অন্তত উগা ওপারা হয়ে উঠতে পারেননি।

ডার্বির দুই অর্ধ ছিল দু’টো টিমের দখলে। শুরুটা বাগানের, পরেরটা ইস্টবেঙ্গলের। বিরতির পর কোণঠাসা মর্গ্যানের টিমকে চাঙ্গা করলেন ওয়েডসন। হাতছাড়া মাঝমাঠকে মুঠোয় পুরলেন তিনিই। তবে চমকে দিলেন বাগান স্টপার এডু। মাঠে থাকা সাত বিদেশির মধ্যে তিনিই সবথেকে বেশি নম্বর পাবেন। একশোয় তাঁকে সত্তর দেওয়া যেতেই পারে।

বিদেশিদের নিয়ে এত মাতামাতি। কোচেদের নির্ভরতা। সতর্কতার মোড়কে মোড়া ম্যাচে আলো ছড়ালেন কিন্তু দু’দলের দুই কিপার আর কয়েক জন বঙ্গ সন্তান। প্লাজার গোল অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় বাঁচিয়ে দেবজিৎ মজুমদার বোঝালেন তাঁর ধারাবাহিক ভাল ফর্ম অটুট। তেমনই সনির সোয়ার্ভিং কর্নার বাঁচিয়ে লাল-হলুদ কিপার রেহনেশ শীর্ষে রেখে দিলেন দলকে। তবে তাঁকে ম্যাচের সেরা বাছা হল কেন, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতেই পারে।

বাগান কোচ সম্ভবত ডার্বি আবেগের কথা ভেবেই টিম নির্বাচনে বঙ্গসন্তানদের প্রাধান্য দিয়েছিলেন। মাঝমাঠে পিভট করেছিলেন প্রণয় হালদার আর সৌভিক চক্রবর্তীকে। ওঁদের দৌরাত্ম্য আর সাহসী মনোভাব লাল-হলুদের সব অঙ্ক ওলট-পালট করে দিল। ভাল খেললেন প্রীতম কোটালও। আর ইস্টবেঙ্গলের অনূর্ধ্ব ২২ নিখিল পুজারির মতোই তারকা হওয়ার আশা জাগিয়ে গেলেন বাগান লেফট ব্যাক শুভাশিস বসু। মাঠে এ দিন উপস্থিত ছিলেন জাতীয় কোচ স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন। ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচের জন্য ভারতীয় দল নির্বাচনের সময় নিখিল-শুভাশিসকে তিনি ডাকলে অবাক হব না।

‘আগে বাঁচো’ মন্ত্রে ডার্বির রং ফিকে হলেও কোচেদের নতুন অঙ্ক কষা শুরু হয়ে গেল এ দিন থেকেই। বাগান এখান থেকেই অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে চলে যাচ্ছে মুম্বই। আর শিলং লাজংয়ের সঙ্গে খেলার জন্য শিলিগুড়িতে থেকে যাচ্ছে মর্গ্যান বাহিনী। সামনে দু’দলেরই কঠিন সময়। মেহতাবদের যেমন বাইরের মাঠে ম্যাচ বাকি ছ’টা, তেমনই দেবজিৎ-সনিদের আই লিগের সঙ্গে খেলতে হবে এএফসি-ও।

আই লিগের ফিরতি ডার্বি সম্ভবত রবীন্দ্র সরোবরে। এপ্রিলের গোড়ায়। তখন লিগ টেবলের অবস্থা কী থাকবে এখনই বলা সম্ভব নয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার এ দিনের মতো পরিস্থিতি থাকলে সরোবরের ম্যাচ কিন্তু রক্তক্ষয়ী হবে। কারণ তখন খেতাবের লড়াই অনেকটাই শেষ পর্যায়ে চলে আসবে।

এ দিনের এক রাশ আফসোস নিয়ে সেই ডার্বির অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর তো কোনও উপায়-ই নেই দুই প্রধানের সমর্থকদের। তত দিন ফেসবুকেই বিপ্লব আর খেউড় চলুক দু’দল বাঙালির। ডার্বির আবেগ আর উত্তেজনা বন্দি হয়ে থাকুক কম্পিউটরের কী-বোর্ডে আর মাউসে।

ইস্টবেঙ্গল: রেহনেশ, রাহুল, গুরবিন্দর, বুকেনিয়া, নারায়ণ, ডিকা, মেহতাব, ওয়েডসন, নিখিল, প্লাজা, রবিন (হাউকিপ)।

মোহনবাগান: দেবজিৎ, প্রীতম, এডু, আনাস, শুভাশিস, কাতসুমি, প্রণয়, সৌভিক, সনি (প্রবীর), জেজে (বলবন্ত) ও ডাফি।

ছবি উৎপল সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Derby East Bengal Mohun Bagan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE