Advertisement
E-Paper

জয়ের আগাম সৌরভেও কলঙ্কের ছায়া

মরণের ঘূর্ণি পিচে এবি তুমি টিকবে কতক্ষণ? সাধারণ বিচারবুদ্ধি বা স্কোরবোর্ড বিচারে প্রাক্-শুক্রবার ভারতীয় ড্রেসিংরুমের আগাম স্লোগান আন্দাজের ব্যাপার থাকলে, অনায়াসে তার রিংটোন বোধহয় এ রকম কিছু করে দেওয়া যেত। অগস্টের কলম্বোর পর শেষ নভেম্বরের ভারত।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৩
অশ্বিনের ক্যারম বলের শিকার হার্মার

অশ্বিনের ক্যারম বলের শিকার হার্মার

মরণের ঘূর্ণি পিচে এবি তুমি টিকবে কতক্ষণ?

সাধারণ বিচারবুদ্ধি বা স্কোরবোর্ড বিচারে প্রাক্-শুক্রবার ভারতীয় ড্রেসিংরুমের আগাম স্লোগান আন্দাজের ব্যাপার থাকলে, অনায়াসে তার রিংটোন বোধহয় এ রকম কিছু করে দেওয়া যেত। অগস্টের কলম্বোর পর শেষ নভেম্বরের ভারত। বিদেশের পর এ বার দেশ। যেখানে চেনা চিত্রনাট্য ধরে চললে ভারতের টেস্ট অধিনায়ক আগামী চব্বিশ ঘণ্টায় সম্ভবত ঘরের মাটিতে তাঁর প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়টাও সম্পন্ন করতে চলেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার আর আটটা উইকেট চাই, হাতে পড়ে তিনটে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। ড্রয়ের কোনও সম্ভাবনা বেঁচে নেই। যে কোনও একটা টিম জিতবে এবং অলৌকিক হলে শুধু টিমটার নাম হবে দক্ষিণ আফ্রিকা। একটা আমলা, একটা এবি ডে’ভিলিয়ার্স, একটা জেপি দুমিনি শুধু তুলতে হবে। আরও ভাল করে বললে, ফর্মে থাকা শুধু একজনকে চাই, যাঁর নাম ডে’ভিলিয়ার্স। প্রতিষেধক হিসেবে রবিচন্দ্রন অশ্বিন আছেন। রবীন্দ্র জাডেজা আছেন। অমিত মিশ্র থাকবেন। অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ঠিক আছে, কেউ না পারলে টিমের ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’ আছে, লোকে যাকে চিনছে জামথা পিচ নামে! বিরাট কোহলির তো বৃহস্পতিবার রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাওয়া উচিত। সুখকর মধুচন্দ্রিমার মঞ্চ তৈরি। বল ঘুরছে, ব্যাটসম্যান নাচছে, এবিদের বাঁচাবে কে?

দুঃখের হল, বিরাট কোহলি সম্ভবত এর পরেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন না। আর কেউ নয়, ওই পরম-নির্ভরতার টুয়েলফথ ম্যানের জন্য। পারবেনও বা কী ভাবে? ক্রিকেটবিশ্বে যে আগুন জ্বলছে। এক-আধ জন নয়, আসরে একের পর এক মেগা ক্রিকেট-ব্যক্তিত্ব। কেউ বলছেন, নাগপুর পিচ স্বয়ং শয়তানের প্রতিভূ। কেউ তেলেবেগুনে খিঁচিয়ে উঠে আইসিসির কাছে কড়া দরবার পেশ করেছেন, পিচের নামে এ সব ‘আখড়া’ তৈরি বন্ধ হোক! আর নামগুলো মোটেও এলেবেলে নয়। মাইকেল ভন। ওয়াসিম আক্রম। মাইকেল ক্লার্ক।

অযথা মুখবন্ধে ঘুরপাক না খেয়ে সোজাসুজি কাহিনিতে ঢুকে পড়া যাক। টেস্ট ক্রিকেটের সলজ্জ বিজ্ঞাপন পেশ করে বৃহস্পতিবার গোটা ক্রিকেটবিশ্বের বিতর্কসভায় নিজেকে বসিয়ে ফেলল নাগপুর। ‘অসহিষ্ণুতা’ নিয়ে যদি দেশ উত্তাল হয়ে থাকে, তবে ক্রিকেট দুনিয়া আপাতত ফুটছে ঘূর্ণি পিচ নিয়ে।

টেস্ট ক্রিকেটের একশো আটত্রিশ বছরের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ঘটনা কম কিছু হয়নি। ডগলাস জার্ডিনের কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ। কিংস্টনের উইকেটে বিষেণ সিংহ বেদীর টিমের অর্ধেককে মাইকেল হোল্ডিংয়ের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া। জামথার বাইশ গজ কাউকে এ দিন হাসপাতালে পাঠায়নি। শুধু টেস্ট ক্রিকেটের আত্মাকে পঙ্গু করে ছেড়ে দিয়েছে।

স্রেফ একটা ‘খোঁয়াড়ে’।

কেউ শুনলে বিশ্বাস করবে, টেস্ট ম্যাচের মাত্র একদিনে কুড়ি উইকেট উড়ে যাচ্ছে! যে ব্যাটসম্যান রাত-প্রহরী হিসেবে আগের দিন নেমেছিলেন, তিনিই আবার পরের বিকেলে নামছেন একই ভূমিকায়? টিমের দ্বিতীয় ইনিংসে? রবিচন্দ্রন অশ্বিনের হাত থেকে আজ এমন একটা বল বেরিয়েছে, যা মাইক গ্যাটিংকে করা শেন ওয়ার্নের ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরিকে’ প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিয়ে গেল! এটা বলা ঘোরতর অন্যায় হবে যে, দিনের কুড়িটা উইকেট এ দিন নাগপুর বাইশ গজ নিয়েছে। নেয়নি। কুড়িটার মধ্যে গোটা বারো ব্যাটসম্যান বিপক্ষকে দিয়ে এসেছে। কিন্তু দিয়ে এসেছে, ঘূর্ণির আতঙ্কে। কোনটা খেলব, কোনটা খেলব না, কোনটায় পা বাড়াব, কোনটায় বাড়াব না-র ধাঁধায় আক্রান্ত হয়ে। ভাবা যায়, একটা সিনেমা শেষ হতে যে সময়টুকু লাগে, তার চেয়েও কমে আজ সকালে শেষ হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা! মাত্র ১২৭ মিনিটে, খেলা শুরুর দেড় ঘণ্টার মধ্যে! আর তার পর ভারত কি না নেমে ঠিকঠাক দু’টো সেশনও বাঁচল না! ঘরের মাঠে তারাও শেষ, একশো তিয়াত্তরে। মোহালির সঙ্গে নাগপুরের নিরন্তর মিল খোঁজা বাদ দিন। এ টেস্ট তো তার প্রথম দিনের সঙ্গে দ্বিতীয়ের মহানাটকীয় সব মিল ছেড়ে যাচ্ছে। গত কাল ভারতের ইনিংস শেষ হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকা নামল। দু’উইকেট পড়া দিয়ে দিন শেষ। এ দিন দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংস শেষের পর ভারত নামল। এবং শেষ পর্যন্ত আবার দক্ষিণ আফ্রিকা আর আবারও দু’উইকেট পড়া দিয়ে দিন শেষ!

লোকে এর পর বলবে না কেন? শুনতেও হবে।

রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে ভারতীয় মিডিয়ার একপ্রস্থ লেগে গেল। তামিলনাড়ু অফস্পিনার এ দিন আবার পাঁচ উইকেট পেলেন, কেরিয়ারের যা চোদ্দোতম। সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, এ রকম পিচ অসাধারণ আর সাধারণ স্পিনারের মধ্যেকার পার্থক্যকে কমিয়ে দেয় কি না। অশ্বিন হাড়হিম দৃষ্টিতে উত্তর দিলেন, “উইকেট নিয়ে কিউরেটরকে বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমার কাজ যা দেওয়া হবে, সেখানে নিজের কাজটা করা। জোহানেসবার্গে খেলার পর আমাকে এক বছর বসতে হয়েছিল। আমি কিন্তু কমপ্লেন করিনি। আজও করছি না।” অশ্বিন এখানে থামলেন না। চিবিয়ে-চিবিয়ে আরও জুড়ে দিলেন, “আর আপনাদেরও পিচের বাইরে রিপোর্ট করার অনেক কিছু আছে। যারা ভাল খেলছে, তাদের নিয়ে লিখুন না। পিচ নিয়ে পড়ে আছেন কেন?” কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া একা পড়ে নেই। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের রাম-শ্যামকে ছেড়ে দেওয়া গেল, কিন্তু ক্লার্ক-ভনরা? তাঁরাও তো ভাল রকম আছেন। নাগপুরে ডে’ভিলিয়ার্সদের অবস্থা দেখে পিচকে টেস্ট ক্রিকেটের পক্ষে ‘ডায়াবলিক্যাল’ লিখে ফেললেন ভন। টুইট করলেন, ‘তোমরা আমাকে বোঝাচ্ছো যে, এটা পাঁচ দিনের উইকেট? এটা টেস্ট ক্রিকেটের পক্ষে ক্ষতিকারক। অসম্ভব ক্ষতিকারক।’ কিছুক্ষণের মধ্যে সেটাকে আবার রিটুইট করে দিলেন ক্লার্ক! সঙ্গে নিজের মতামত ভাল ক্রিকেট বলতে আমি বুঝি যে উইকেটে সবার জন্য কিছু না কিছু থাকবে। প্রথমে সুইং, সিম। তার পর উইকেট ব্যাটসম্যানের। আর তৃতীয় থেকে পঞ্চম, বল ঘুরবে। এবং কেউ হারবে, কেউ জিতবে। যা সঙ্গে সঙ্গে আবার টুইট মারফত প্রাক্তন ইংরেজ অধিনায়কের সমর্থন পেয়ে গেল। শন পোলকেরও দেখা গেল মুখ গোমড়া। লাঞ্চে মাঠে শো করতে গিয়ে বলে ফেললেন যে, কমেন্ট্রি বক্সে বসে টেস্ট পাঁচ দিন গড়াবে বলাটা মোটেও কাম্য নয়। আর সব শেষে মঞ্চে ওয়াসিম আক্রম। যিনি কলামে লিখে দিলেন, ‘বিশ্ব জুড়ে কোথায় কেমন পিচ তৈরি হচ্ছে, আইসিসির এ বার সেটা দেখুক। নইলে পয়েন্ট কাটা হোক যাতে র‌্যাঙ্কিং আক্রান্ত হয়। যত দিন না হবে, এ সব আখড়া দেখতে হবে।’

চরম তিতকুটে বিশেষণ ব্যবহার, দাঁত-নখ উদ্যত করে আক্রমণ। কোনও সন্দেহ নেই, অবচেতনে অশ্বিন-জাডেজাদের রেখে দক্ষিণ আফ্রিকা এ দিন নেমেছিল। দু’প্লেসি জাডেজার স্ট্রেটারে যে ভাবে আড়াআড়ি সুইপে বোল্ড হলেন, সেখানে পিচের কিছু করার ছিল না। কিন্তু অশ্বিনের যে ক্যারম বলটা লেগস্টাম্পের প্রায় ফুট দু’য়েক বাইরে থেকে চকিত টার্নে হার্মারের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে অফস্টাম্প নিয়ে গেল, সেটা? আগুনে পেসার মর্নি মর্কেলের মাঝেমধ্যে অফস্পিন বা ফ্লাইট করানোর ব্যাখ্যাও আছে কি? এবি ডে’ভিলিয়ার্সের আউটের বলটাও অনেকটা ঘুরল। এ সবের চেয়েও বড় প্রামাণ্য, ভারত নিজেও পারেনি। সরাসরি ঘূর্ণি হোক বা ঘূর্ণির ভয়েই হোক, কোহলিরাও ঘায়েল হয়েছেন। অজিঙ্ক রাহানের মতো টেকনিক্যালি পোক্ত ব্যাটসম্যান অদ্ভুত ড্রাইভের প্রচেষ্টায় গিয়ে শেষ পর্যন্ত শর্ট থার্ড ম্যানে তুলে দিয়েছেন। চেতেশ্বর পূজারা সামান্য টার্নের বিভ্রান্তিতে বোল্ড। তা হলে? আর বোধহয় তাই, ছায়াটা মোছা যাবে না। শুক্রবার জিতে গেলেও যাবে না।

কলঙ্কের ছায়া। সিরিজ জয়ের আগাম সৌরভও যার আক্রমণে এখন পূতিগন্ধময়, প্রভাবেও যা বাহ্যিক ফলাফলের সীমানা ছাড়িয়ে দূরবিস্তৃত।

ভারত প্রথম ইনিংস ২১৫।

দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ইনিংস (আগের দিন ১১-২)

এলগার বো অশ্বিন ৭

আমলা ক রাহানে বো অশ্বিন ১

ডে’ভিলিয়ার্স ক ও বো জাডেজা ০

দু’প্লেসি বো জাডেজা ১০

দুমিনি এলবিডব্লিউ মিশ্র ৩৫

ভিলাস বো জাডেজা ১

হার্মার বোল্ড অশ্বিন ১৩

রাবাদা ন.আ ৬

মর্কেল ক ও বো অশ্বিন ১

অতিরিক্ত

মোট ৭৯।

পতন: ১১, ১২, ১২, ৩৫, ৪৭, ৬৬, ৭৬, ৭৯।

বোলিং: ইশান্ত ২-১-৪-০, অশ্বিন ১৬.১-৬-৩২-৫,

জাডেজা ১২-৩-৩৩-৪, মিশ্র ৩-০-৯-১।

ভারত

দ্বিতীয় ইনিংস

বিজয় ক আমলা বো মর্কেল ৫

ধবন ক ভিলাস বো তাহির ৩৯

পূজারা বো দুমিনি ৩১

কোহলি ক দু’প্লেসি বো তাহির ১৬

রাহানে ক দুমিনি বো তাহির ৯

রোহিত ক এলগার বো মর্কেল ২৩

ঋদ্বিমান ক আমলা বো তাহির ৭

জাডেজা বো হার্মার ৫

অশ্বিন এলবিডব্লিউ মর্কেল ৭

মিশ্র বো তাহির ১৪

ইশান্ত ন.আ ১

অতিরিক্ত ১৬

মোট ১৭৩।

পতন: ৮, ৫২, ৯৭, ১০২, ১০৮, ১২২, ১২৮, ১৫০, ১৭১, ১৭৩।

বোলিং: মর্কেল ১০-৫-১৯-৩, হার্মার ১৮-৩-৬৪-১,

রাবাদা ৫-১-১৫-০, দুমিনি ২-০-২৪-১, তাহির ১১.৩-২-৩৮-৫।

দক্ষিণ আফ্রিকা

দ্বিতীয় ইনিংস

এলগার ব্যাটি‌ ১০

ফান জিল ক ইশান্ত বো অশ্বিন ৫

ইমরান তাহির এলবিডব্লিউ মিশ্র ৮

আমলা ব্যাটিং ৩

অতিরিক্ত

মোট ৩২-২।

পতন: ১৭, ২৯।

বোলিং: ইশান্ত ৩-১-৬-০, অশ্বিন ৬-২-১২-১,

জাডেজা ৪-২-৬-০, মিশ্র ১-০-৩-১।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy