Advertisement
E-Paper

‘ওহে মোদী, যুদ্ধের ভয় দেখিও না, শান্তির জন্য বরং ক্রিকেট খেলাও’

প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে রয়েছেন। লং ডিস্টেন্স কলেও গলা শুনলে মনে হবে এখুনি যেন নিজেই সীমান্তে চলে যেতে রাজি। এত ক্ষুব্ধ যে, টানা চল্লিশ মিনিটের কথোপকথনেও উত্তেজনা কমছে না। করাচির বাড়ি থেকে শনিবার রাত দশটা নাগাদ ফোনে আনন্দবাজারকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১০:১৭

প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে রয়েছেন। লং ডিস্টেন্স কলেও গলা শুনলে মনে হবে এখুনি যেন নিজেই সীমান্তে চলে যেতে রাজি। এত ক্ষুব্ধ যে, টানা চল্লিশ মিনিটের কথোপকথনেও উত্তেজনা কমছে না। করাচির বাড়ি থেকে শনিবার রাত দশটা নাগাদ ফোনে আনন্দবাজারকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ।

প্রশ্ন: ভারতে রব উঠেছে উরির ঘটনার পর পাকিস্তানের সঙ্গে এখন আর ক্রিকেট না খেলার।

মিয়াঁদাদ: খেলবে না খেলবে না। ভারত কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? উই আর নট বদার্ড। বহু বছর ধরেই তো ভারত আমাদের সঙ্গে খেলছে না। আমরা বিশ্বের এখন এক নম্বর টিম। ভারত র‌্যাঙ্কিংয়ে দুই। এ বার সত্যিকারের এক কে, সেটা নিষ্পত্তির জন্য ভারত যদি খেলতে না চায়, ভাল কথা। কেউ ওদের সাধতে যাবে না।

প্র: উরিতে যে ভাবে জওয়ানদের হত্যা করা হয়েছে, তাতে পাকিস্তান-বিরোধী প্রতিক্রিয়া কি স্বাভাবিক নয়?

মিয়াঁদাদ: (প্রচণ্ড গলা চড়িয়ে) কোনও গ্যারান্টি আছে ওটা পাকিস্তান মেরেছে? একটা প্রুফ দেখাতে পারবেন যে, সরকার ইনভলভ্‌ড ছিল? ও রকম একটা হাই সিকিওরিটি জোন। সেখানে সীমান্তের ওপার থেকে এসে মেরে দিয়ে চলে গেল, এটা হতে পারে? ইন্ডিয়ায় এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মোদী গভর্মেন্টের রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্লেম পে ব্লেম। যেখানে যা কিছু হবে, পাকিস্তান। সব খারাপ কাজের জন্য পাকিস্তান দায়ী। আচ্ছা ভাই আপনাকে দুটো প্রশ্ন করি।

প্র: করুন।

মিয়াঁদাদ: খালিস্তান মুভমেন্টে কি পাকিস্তান ছিল? গুজরাতে মোদীর গণহত্যা কি পাকিস্তান করিয়েছিল?

প্র: আপনি তো প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন।

মিয়াঁদাদ: উত্তেজিত তো হবই। গোটা পাকিস্তানি আওয়াম রেগে গিয়েছে। ভেবেছেটা কী ভারত? যুদ্ধের হুমকিতে আমরা কেঁপে যাব? খুব ভুল করছে। আমরা অনেক পুঁচকি দেশ হতে পারি। কিন্তু আমার দেশের মানুষ মরতে ভয় পায় না। বরং মনে করে এ রকম বীরত্বের মৃত্যু হলে তারা বেহেস্তে যাবে। মনে রাখবেন, আপনাদের যেমন ক্ষেপণাস্ত্র আছে আমাদেরও তেমন ক্ষেপণাস্ত্র আছে। লড়াই হলে কারওরই কোনও সুবিধে হবে না।

প্র: দু’দেশের মহাতারকা ক্রিকেটাররা এমন উত্তেজক পরিস্থিতিতে কোনও ভূমিকা নিতে পারেন? যেমন আপনি, ইমরান, জাহির। এ দিকে সচিন, কপিল, গাওস্কর।

মিয়াঁদাদ: ক্রিকেটাররা কী করবে? এগুলো তো হচ্ছে রাজনীতিবিদদের থেকে। বেচারি ক্রিকেটারের হাতের বিষয়ই নয়। সব করছে ওই একটা লোক। মোদী। আমি অ্যাকচুয়ালি বাজপেয়ীকে খুব মিস করছি। উনি আর আডবাণী মিলে মধ্যিখানে দু’দেশের মধ্যে একটা শান্তির পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।

প্র: আপনি মোদীকে দোষ দিচ্ছেন। অথচ মোদী বারবার পাকিস্তানের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এমনকী নওয়াজের জন্মদিনে পাকিস্তান ঘুরেও গিয়েছেন।

মিয়াঁদাদ: তাতে কিছুই বদলাচ্ছে না। ওর অতীতই যথেষ্ট। ও তো নিজের মুখে বলেছে গোধরায় ও কী করেছে। এ রকম একটা লোক যদি একটা দেশের নেতৃত্বে থাকে, যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

প্র: আপনি কি নওয়াজকে ধোয়া তুলসিপাতার সার্টিফিকেট দিচ্ছেন?

মিয়াঁদাদ: আরে ভাই নওয়াজ তো এতটা নীচে নামেনি যে, সব কিছুর জন্য ভারতকে দায়ী করছে! আজকে টিভিতে শুনলাম পাকিস্তানি শিল্পী আর গায়কদের আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছেড়ে যেতে বলা হবে। কী অপমানজনক ভাবুন! ওদের ডেকে আনা হয়েছে। ওরা আপনাদের কাছে মেহমানের মতো। হঠাৎ তাদেরই কি না বলা হচ্ছে, যাও বেরিয়ে যাও! ভারতীয় অনেক শিল্পীরা তো এখানে আসেন। আমরা একজনের সঙ্গেও এ রকম ব্যবহার করেছি?

প্র: সে তো কয়েক মাস আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইডেন গ্যালারিও পাকিস্তান টিমকে অঢেল ভালবাসা দিয়েছে।

মিয়াঁদাদ: সেটা সম্ভব হয়েছিল কলকাতা বলে। ভারতের ওই একটা জায়গা যেখানে আমরা সব সময় সাপোর্ট আর নিরপেক্ষতা পেয়েছি। আমার কাছে ইডেন সর্বকালের সেরা নিরপেক্ষ মাঠ হয়ে থাকবে। যারা নিজের টিমের এক নম্বর প্লেয়ার গাওস্করের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছিল। জাস্ট এই ঘটনাটাই প্রমাণ করে যে, আমার নিজের সুপারস্টারকেও যদি কোনও কারণে অপছন্দ হয়, আমি আওয়াজ তুলতে দ্বিধা করব না। আমার আপত্তি হল, ম্যাচটা তো অরিজিন্যালি কলকাতায় ছিল না। ধর্মশালা করতে পারল না বলে এল। মোদীর কাছে আমার প্রশ্ন, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাই তুমি সুনিশ্চিত করতে পারো না, তুমি কী পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলছ?

প্র: অভ্যন্তরীণ বলতে?

মিয়াঁদাদ: এই যে পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগানে একটা শহর থেকে ম্যাচ চলে যাওয়া। কই আমাদের দেশে তো কখনও হয়নি। কাল যদি বিরাট কোহালি বলে লাহৌরে খেলতে চাই, লাহৌরেই খেলবে। করাচি হলে করাচি। গুজরানওয়ালা হলে গুজরানওয়ালা। কোথাও কোনও প্রবলেম হবে না। আজ অবধি হয়ওনি। ভারত থেকে যত মেহমান এসেছে, হাসি মুখে নিয়ে ফেরত গেছে।

প্র: সে তো পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সত্যি। পাকিস্তান যখন খেলতে এসেছে, পাক সমর্থকদের যথেষ্ট আতিথেয়তা দেখানো হয়েছে।

মিয়াঁদাদ: আমার বক্তব্য শুধু সেটা নয়। আমি বলতে চাইছি যে সরকার দেশে একটা বিক্ষোভ সামাল দিতে পারে না, যারা নিজের সেনা ছাউনির মধ্যে বলে অন্য দেশ মেরে দিয়ে যাচ্ছে, তাদের কী বিশ্বাসযোগ্যতা, বোঝাই যাচ্ছে। আরে ভাই, নিজের দেশকেই তুমি ম্যানেজ করতে পারছ না। তুমি অন্য দেশের দিকে আঙুল তোলো কী করে?

দু’দেশের সম্পর্ক খারাপ এই লোকগুলোই করে। নিজের স্বার্থে করে। দু’দেশের জনগণ করে না।

প্র: আপনি নিজেই তো রাজনৈতিক নেতাদের মতো কথাবার্তা বলছেন।

মিয়াঁদাদ: একটুও না। বরং আমি সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট থেকে বলছি। ভারতকে মনে রাখতে হবে, পৃথিবী আগের মতো নেই। মিডিয়াও আর আগের সেই মিডিয়া নয়। এখন সবাই জানে কোথায় কী হচ্ছে। আমার প্রস্তাব হল, একটা গণভোট করা হোক ভারতে। দেখা হোক পাকিস্তান সম্পর্কে কী মনোভাব।

প্র: আপনার মতে সেই ভোটে কী হবে?

মিয়াঁদাদ: শতকরা নব্বই শতাংশ বলবে পাকিস্তান নিয়ে তাদের কোনও অসূয়া নেই। বলবে না দশ শতাংশ। ঠিক সেই পার্সেন্টেজ যারা ঘোঁটটা পাকাচ্ছে।

প্র: সরাসরি বলুন আপনার মতে উরির ঘটনায় পাকিস্তান জড়িত নয়?

মিয়াঁদাদ: অবশ্যই নয়। উগ্রপন্থী আক্রমণ তো এখন পৃথিবীর সর্বত্র হচ্ছে। আমাদের দেশে দৈনিক কত লোক মারা যাচ্ছে জানেন? আমাদের তো তা হলে বলতে হয় প্রত্যেকটা উগ্রপন্থী আক্রমণের জন্য ভারত দায়ী।

প্র: এই সময় নামী ফিল্মস্টার বা ক্রিকেটাররা কি গুডউইল অ্যাম্বাস্যাডরের কাজ করতে পারেন?

মিয়াঁদাদ: করতে পারলে ভাল হত। ক্রিকেটার বা ফিল্মস্টারদের ভালবাসার ব্যাপারে তো মধ্যিখানে কোনও কাঁটাতার নেই। বিরানব্বইয়ে আমরা যখন বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছি, ভারত থেকে প্রচুর সাপোর্ট পেয়েছিলাম। সমস্যা হল আমাদের হাতে তো কিছু নেই। কে শুনছে আমাদের কথা? সব ঠিক করছে পলিটিশিয়ানরা। আর নিজেদের ধান্দার জন্য বিরোধটা জিইয়ে রাখছে।

প্র: উরির ঘটনার পর ভারতীয় জনগণও কিন্তু খুব ক্ষুব্ধ।

মিয়াঁদাদ: আমি বিশ্বাস করি না। বরং আমি মোদীকে বলতে চাই, দুবাইয়ে যখন প্রবাসী ভারতীয়রা বসে পাকিস্তানের ম্যাচ দেখেন, কই তাঁদের চোখে তো আমি কোনও বিদ্বেষ দেখি না। কানাডায়, আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে, দুবাইয়ে, যখন পাকিস্তানি আর ভারতীয়রা পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বসবাস করেন, তখন তাঁদের মধ্যে তো কোনও ক্ষোভ দেখি না। তা হলে এই দুটো দেশের মধ্যে তৈরি হয় কেন?

প্র: ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড প্রধানও তো বলেছেন, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট নয়।

মিয়াঁদাদ: ভারতীয় বোর্ডের কথা ছাড়ুন। চিরকাল নিজেদের ধান্দায় পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান এসেছে, এরা হোম সিরিজ করে মাল তুলে নিয়েছে। পাল্টা যখন যাওয়ার কথা ছিল, যায়নি। এই তো ক’বছর আগে জারদারির আমলে পাকিস্তান পাঁচটা ম্যাচ খেলে গেল ভারতে। স্রেফ এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে যে, এর পর ভারতও আসবে। কোথায় কী? পাকিস্তান আসা দূরস্থান, ভারত দুবাই অবধি খেলতে যেতে রাজি হল না। আজ বলছে খেলবে না। আমরা বলছি, এটা আর নতুন কথা কী? তুমি তো ভাই বহু বছরই খেলছ না। যখন নিজের দেশে ওয়ার্ল্ড কাপ করছ, তখন আমাকে ব্যবহার করছ। ওয়ার্ল্ড কাপ শেষ হয়ে গেলেই আমি আবার ছিবড়ে।

প্র: আপনার মতে দু’দেশে টেনশন তা হলে কমবে কী ভাবে?

মিয়াঁদাদ: ক্রিকেট দিয়েই কমাতে হবে। যুদ্ধ করে কোনও লাভ নেই। যুদ্ধের পরিণতি ভয়ঙ্কর। আবার বলি, মুসলমানরা যুদ্ধে ভয় পায় না। প্রশ্ন হল, আমার মতো— আমার বয়সীরা তো জীবন কাটিয়ে ফেলেছে। আমার পরের প্রজন্ম, যারা জীবন দেখেনি, তারা যুদ্ধে প্রাণ দেবে কেন?

প্র: ক্রিকেটীয় সমাধান তা হলে কী ভাবে?

মিয়াঁদাদ: আমার মতে দু’দেশের মধ্যে দুটো প্রতীকী ম্যাচ হোক। সেটা ওয়ান ডে হতে পারে কী টি-টোয়েন্টি। একটা ম্যাচ হবে পাকিস্তানে, একটা ভারতে।

প্র: পাকিস্তানে তো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট হয় না।

মিয়াঁদাদ: এটা তেমন হলে ফ্রেন্ডলিও করা যেতে পারে। কিন্তু দু’দেশেই হতে হবে। নইলে আওয়ামের বিশ্বাস ফিরবে না। ভারতীয় বোর্ডের চিরাচরিত ব্যবহার চলবে না। এক বার আমরা যাব, এক বার তোমরা আসবে। আমার স্লোগান— যুদ্ধে যেও না, ক্রিকেটে ফেরো।

Javed Miandad
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy