Advertisement
E-Paper

ভারত হেরেও জয়ী ধোনিতে

এমসিএ প্যাভিলিয়নের সামনে জালের প্রাচীরটা বোধহয় এ বার ভেঙেই পড়বে। মোবাইল ক্যামেরা অন করে ঝুঁকে পড়েছে অসংখ্য হাত, অসীম আকুতি নিয়ে কেউ কেউ টপকে নেমে আসতে চাইছেন ওই অসহ্য পাঁচিল টপকে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৬
দক্ষিণ আফ্রিকার গোলাগুলির জবাব দিচ্ছে ধোনির ব্যাট।

দক্ষিণ আফ্রিকার গোলাগুলির জবাব দিচ্ছে ধোনির ব্যাট।

দক্ষিণ আফ্রিকা: ১৯৬-৮

(২০ ওভার)
ভারত: ১৯২-৩ (২০ ওভারে)

এমসিএ প্যাভিলিয়নের সামনে জালের প্রাচীরটা বোধহয় এ বার ভেঙেই পড়বে। মোবাইল ক্যামেরা অন করে ঝুঁকে পড়েছে অসংখ্য হাত, অসীম আকুতি নিয়ে কেউ কেউ টপকে নেমে আসতে চাইছেন ওই অসহ্য পাঁচিল টপকে। ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে যে লোকটা, সে কোনও দিকে তাকাচ্ছে না। ব্যাটটা দুলছে প্রবল দৃপ্ত ভঙ্গিমায়, একটু আগে যা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল অসম্ভব। ওয়াংখেড়ে কাঁপিয়ে আবার ফিরছে সেই আদিম আওয়াজ। চরিত্র পাল্টে, নতুন চরিত্র খুঁজে। স্যা-চি-ন...স্যা-চি-ন নয়, ধো-ও-নি...ধো-ও-নি...।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কিন্তু আজ জেতেননি। হেরে গিয়েছেন।

মাঠের মধ্যে ‘এমএস সেভেন’কে ছুটে এসে দাঁড় করাচ্ছেন কে? এবি ডে’ভিলিয়ার্স না? এত দূর থেকে ঠিক বোঝা গেল না। যেই হন, তিনি কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছেন, ছেড়ে দিয়ে আসছেন ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি পর্যন্ত। মাঝে মাঝে পিঠে চাপড় পড়ছে, গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা টিম এখন পিছন-পিছন। দাঁড় করিয়ে হাত মিলিয়ে যাচ্ছেন।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কিন্তু আজ জেতেননি। হেরে গিয়েছেন।

ক্রিস মরিসকে দেখে মনে হচ্ছে, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন যেন। এত চাপের শেষ ওভার কোনও প্র্যাকটিস ম্যাচে তাঁকে করতে হয়েছে কি না কে জানে। প্রেস কনফারেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকা পেসারকে জিজ্ঞেস করা হল, এমএসডি-র বিরুদ্ধে শেষ ওভারের সময় কী ভাবছিলেন? মরিস মুচকি হেসে বললেন, “সেটা আপনাদের বলে দিই আর টিম থেকে বাদ পড়ি! সেটাই চাইছেন, তাই তো?” তার পরে, ‘‘এদের বিরুদ্ধে কোনও প্ল্যান কাজ করে না। লাকে চলতে হয়।’’

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কিন্তু আজ জেতেননি। হেরে গিয়েছেন।

পৃথিবীতে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব থাকে যাদের ভাবনা-চিন্তা, আচার-আচরণ, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সবই আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা হয়। ডাল-ভাতের পানসে জীবন তাদের পছন্দ হয় না। তারা ছুটতে চায় অসম্ভবের পিছনে, উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টিতেই এদের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ। এদের কেউ বলে অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়। কেউ বলে জিনিয়াস। কারও কাছে এরা শুধুই ব্যতিক্রমী।

এমএস ধোনিকে যা কিছু বলে ডাকা যায়।

একটা প্র্যাকটিস ম্যাচে সাধারণত কী ঘটে থাকে? যতই হোক প্রাক্-বিশ্বকাপ ম্যাচ, আদতে তো প্রস্তুতি পর্ব। যেখানে সাধারণ বুদ্ধিতে দুটো টিম দেখে নিতে চাইবে নিজেদের বেঞ্চ স্ট্রেংথ। খুলতে চাইবে কোনও প্লেয়ারের ফিটনেস-জট, দেখবে সে টুর্নামেন্টে শেষ পর্যন্ত নামতে পারবে কি না। প্রধান অস্ত্রদের টিম বসাবে। চাপের মুখে ঠেলে দেবে পরিবর্তদের। রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত প্র্যাকটিস ম্যাচের চেনা চিত্রনাট্য ধরেই ব্যাপারটা এগোচ্ছিল। ধোনি টিমে রবিচন্দ্রন অশ্বিন-আশিস নেহরাকে রাখেননি। দক্ষিণ আফ্রিকা এবি ডে’ভিলিয়ার্সকে খেলায়নি। ভারতীয় বোলিংকে বেধড়ক ঠেঙিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রায় দু’শো তুলে দিয়েছে। যা শিখর ধবন-সুরেশ রায়না মিলে তাড়া করছেন ঠিকই, ৬৯ বলে ৯৪ রানের একটা পার্টনারশিপও হয়েছে, কিন্তু সেই টার্গেট ছোঁয়ার বিশ্বাসটা যেন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিতব্য ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে— শেষ পর্যন্ত টানবে ঠিকই। কিন্তু টেনেও ভারত পারবে না।

আচমকা দেখা গেল, প্রেসবক্সের উল্টো দিকে কেউ একটা ওয়ার্ম আপ করছে। ভুল। দু’জন। ওভারটা শেষ হল। এবং এক নয়, রায়না-ধবন একসঙ্গে দু’জনকে মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হল! কারও হাত দিয়ে স্লিপ পাঠিয়ে নয়, রীতিমতো হাত নেড়ে ডেকে। ডাকছেন কে? কে আবার, ধোনি। সঙ্গে নামছেন কে? কে আবার, যুবরাজ সিংহ। নিজেদের একটা পরীক্ষায় ফেলে দিলেন ধোনি নিজেই।

হাতে চার ওভার। রান চাই ৫৫। এবং ওয়াংখেড়েতে পাঁচ বছর আগের বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতানো জুটি!

ধোনি নেমে দ্বিতীয় বলটাই মিড অনের উপর দিয়ে সপাটে চালালেন। পরেরটা আবার চার, এ বার কভার। পড়ে থাকা চার ওভারের একটা গেল। রান উঠল ১২। সতেরো নম্বর ওভারে এলেন ডেল স্টেইন। এবং প্রথম বলটাই উড়ে গেল গাড়ওয়াড়ে প্যাভিলিয়নের সেকেন্ড টিয়ারে! ভাবা যায়, যে ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া টার্গেটের ধারেকাছে পৌঁছনো অসম্ভব মনে হচ্ছিল একটা সময়, যে ম্যাচে মনে হচ্ছিল টিমের আচমকা বোলিং-লোডশেডিং দিয়ে শিরোনাম করে ম্যাচ রিপোর্ট করতে হবে, সেই ম্যাচে আচমকা অন্য আলো জ্বালিয়ে দিলেন ধোনি। ৪ ওভারে ৫৫ তাড়া করতে গিয়ে ওভার পিছু রান ওঠার হিসেবটা নিন। ১২। ১২। ১৫। ১৪। শেষ ওভারেও দরকার ছিল ১৪ আর শেষ বলে পাঁচ! ধোনি আগেরটায় বাউন্ডারি মেরেছিলেন। কিন্তু শেষেরটায় ঠিকমতো কানেক্ট হল না। ভারত অধিনায়ককে দেখা গেল হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন। বিষাদে। আর ওয়াংখেড়ে যে দীর্ঘশ্বাসটা ফেলল, শুনলে মনে হবে ভারত বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরেছে!

ব্যাপারটাকে নাটুকে, বাড়াবাড়ি মনে হলে দোষ দেওয়া যাবে না। প্র্যাকটিস ম্যাচ হলেও, ভারত হারলেও, পরিস্থিতি বিচারে শনিবারের ওয়াংখেড়ের কাছে তো ওটা দাঁড়িয়েছিল প্রাপ্তির একমাত্র মুহূর্ত। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল পড়েছে বলে ভারতের ম্যাচ মুম্বই পায়নি। এ দিনের ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা মুম্বইবাসীর কাছে তাই ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। আর গোটা ম্যাচে কী দেখতে হয়েছে? মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের জসপ্রীত বুমরাহ-র লাঞ্ছনা। জেপি দুমিনির হাতে ভারতীয় বোলিংয়ের নতুন স্বপ্নের এক ওভারে ২০ রান দিয়ে যাওয়া। ডি’ককদের লেগস্টাম্প গার্ড নিয়ে অফের উপর দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার উত্তর ভারতীয় স্পিনারদের দিতে না পারা। দিশাহীন দাঁড়িয়ে থাকা। তখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছিল প্রাপ্তির এক, দুই ও তিন শুধু মহম্মদ শামি। আজও দু’টো উইকেট এল, ছন্দেও দেখিয়েছে। কোথাও কোনও সমস্যা দেখা যায়নি। হয়তো বা এর পর বিশ্বকাপ টিমেও ঢুকে যাবেন। ভুবনেশ্বর কুমারকে আর টিমের সঙ্গে ঘুরতে হবে না।

কিন্তু তখনও পর্যন্ত যে ধোনি নামেননি।

রান খুব বেশি করেননি তিনি। ১৬ বলে ৩০ নট আউট। কিন্তু একটা জিনিস শনিবারের এমএসডি বুঝিয়ে গেলেন। ভারতীয় বোলিংয়ের যে দিন ‘অফ ডে’ যাবে, যে দিন সামনে দুশো টার্গেট ছুড়ে দেবে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দুর্ধর্ষ কোনও প্রতিপক্ষ, দেশবাসীর ঘাবড়ানোর দরকার নেই।

তিনি আছেন, সামলে দেবেন। আছেন ঠিক পাঁচ বছর আগেরই মতো, ‘বেস্ট ফিনিশার অব দ্য গেম’। চার রানে হার রোজ-রোজ হবে না। তিনি থাকলে এখনও, আজও দশ বারে ন’বার দেশ জিতবে। বোলিং নিয়ে খুচরো আশঙ্কার দিনে যা বড় দরকার ছিল।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আজ হারেননি। জিতে গিয়েছেন!

dhoni india south africa MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy