মাঠে সাত জন স্লিপ ফিল্ডার। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ।
স্কোরবোর্ডে অসম ১-৪। না, ফুটবল নয়। ছাপার ভুলও নয়, এক রানে চার উইকেট।
অশোক দিন্দা ০-৪। এটাও ভুল নয়। কোনও রান না দিয়েই চার উইকেট।
বাংলার ক্রিকেট শেষ কবে এমন দৃশ্য দেখেছে? আদৌ দেখা গিয়েছে কি?
বেপাড়ায় গিয়ে মস্তানির আর বাকিটা কী রইল!
বেপাড়া না, বর্ষাপাড়া। সেই বর্ষাপাড়ায় সারা দিন বাংলার রান-বৃষ্টির পর শেষ বেলায় তুফান তুললেন দিন্দা।
আর তাতে তিন নয়, ছয়ও নয়। এই ম্যাচ থেকে সাত পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ টপ করে রঞ্জির নক আউটে ওঠার স্বপ্ন দেখা শুরু মনোজ তিওয়ারিদের।
এই মরসুমে এত দিন যে মঞ্চ ছিল অসম পেসারদের, এ বার সেই বাইশ গজে ম্যাজিক দেখানো শুরু করে দিলেন দিন্দা। এই উইকেটে এ রকম ভয়ঙ্কর স্পেল যে তিনি আগে দেখেননি, তা কার্যত স্বীকারই করে নিলেন অসম কোচ।
বাংলার অতীত পেস তারকা দত্তাত্রেয় মুখোপাধ্যায় বা গৌতম সোম জুনিয়ররাও তাঁদের সময় এমন বিধ্বংসী বোলিংয়ের কথা মনে করতে পারছেন না। দত্তাত্রেয় শুধু মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘১৯৯০-এর ফাইনালে আমি শুরুতে সাত ওভারে তিন উইকেট নিয়েছিলাম আর সাগরময় (সেনশর্মা) একবার মুম্বইয়ে, আর একবার অসমেই ৫-৬ ওভারের মধ্যে পরপর তিন-চারটে উইকেট তুলে নিয়েছিল। কিন্তু দিন্দার এই স্পেলটা বোধহয় সবচেয়ে বিধ্বংসী।’’
বুধবার দিনের শেষে তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ ২-২-০-৪। ‘‘অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়’’, সন্ধ্যায় স্টেডিয়াম ছাড়ার আগে বাংলার কোচ ও ক্যাপ্টেন দু’জনেই বলে গেলেন। মনোজ হোটেলের পথে রওনা হওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘কাল বলেছিলাম না, ওদের দেড়শোয় নামিয়ে দেব? রানটা বোধহয় একটু বেশিই বলেছিলাম।’’ আর দিন্দা হোটেলে ফিরে বললেন, ‘‘জানতাম দিনের শেষে ওই দু’ওভারই হাতে পাব। দু’ওভারেই দলকে অ্যাডভান্টেজ এনে দেওয়া ছিল লক্ষ্য। স্টাম্প টু স্টাম্প বল করার পরিকল্পনা নিয়েই দৌড় শুরু করি। যা চেয়েছিলাম, তা-ই পেয়েছি।’’ ম্যাচের আগের দিন নেটে খুব অল্প বল করেছিলেন। ম্যাচের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন শেষ কুড়ি মিনিটের আগে মাঠে নামতেই হয়নি। শক্তিটা সঞ্চয় করে যে ভাবে ঘূর্ণিঝড় হয়ে আছড়ে পড়লেন বিপক্ষের উপর, তা অভাবনীয়।
কল্যাণীতে (৭-১৯) যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই গুয়াহাটি অভিযান শুরু করলেন নৈছনপুর এক্সপ্রেস। অসমের বিরুদ্ধে লড়াই সত্যি অসম করে তো তুললেনই, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনশো উইকেটও নিয়ে ফেললেন। এ দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর যাঁর কাছে পৌঁছে যায় সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনন্দনসূচক এসএমএস।
আগের দিন সায়নশেখর মণ্ডলের ৮৭। এ দিন উইকেটকিপার শ্রীবৎস গোস্বামীর (১১২ ন.আ) রানের খরা কাটানো সেঞ্চুরি এবং এই মরসুমেই রঞ্জি অভিষেক হওয়া পঙ্কজ সাউয়ের ৯৯-এর ইনিংস। এই ত্রয়ীর পারফরম্যান্সে ভর করে ওঠা ৪৪৪-৬–এ ইনিংস ডিক্লেয়ার করে বাংলার ক্যাপ্টেন মনোজ প্রথমে ভেবেছিলেন পরের দু’দিনে বিপক্ষকে দু’বার ব্যাট করতে পাঠাবেন।
কিন্তু এ দিন পড়ন্ত বিকেলে জ্বলে ওঠা দিন্দা ইঙ্গিত দিলেন, দেড়শোর মধ্যে অসম দু’বার আউট হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ইনিংসের প্রথম বলই শর্ট পিচড। বুঝে ওঠার আগে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে অভিমন্যু ঈশ্বরনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান ওপেনার পল্লব দাস।
ওই ওভারেরই শেষ বলে ফের আঘাত। অফ স্টাম্পের বাইরে যাওয়া বল ক্যাপ্টেন গোকুল শর্মার ব্যাট ছুঁয়ে সোজা শ্রীবৎসের গ্লাভসে। অসম তখন ০-২। আকস্মিকতায় হতভম্ব।
দিন্দার তিন নম্বর শিকার রাহুল হাজারিকা। দ্বিতীয় ওভারে প্রথম বলেই। অব্যর্থ ইন কাটারে পরিষ্কার এলবি। বিপক্ষ শিবিরকে ত্রস্ত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। আতঙ্কে প্রায় কাঁপতে থাকা নৈশপ্রহরী অরূপ দাসের স্টাম্প ছিটকে যায় দিন্দার দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলে।
অসম এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে। বৃহস্পতিবার এই শহরে বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। তবে বাংলার শুধু বিপক্ষের কুড়ি উইকেট তোলার ভাবনা।
শেষ বিকেলে দিন্দার এই ঝড় ভুলিয়ে দিতে চাইল শ্রীবৎস গোস্বামী-পঙ্কজ সাউদের ১৭৪-এর পার্টনারশিপও। পঞ্চাশের পর মাঝে মাঝেই রিভার্স সুইপ করছিলেন আত্মবিশ্বাসী পঙ্কজ। সেই রিভার্স সুইপই এক রানের জন্য প্রথম ফার্স্ট ক্লাস সেঞ্চুরিটা করতে দিল না তাঁকে। তবে বীরেন্দ্র সহবাগ স্টাইলে লং অন দিয়ে চার হাঁকিয়ে একশোর গণ্ডি ছুঁলেন শ্রীবৎস। বোঝা গেল আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে গিয়েছেন। ২০০৮-এ রঞ্জি অভিষেকের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এটাই তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি। উৎসর্গ করলেন প্রয়াত ঠাকুরদাকে।
কিন্তু তাঁদের সারা দিনের লড়াই মাত্র কুড়ি মিনিটেই পিছনে ফেলে দিলেন যিনি, তিনি দিন্দা।
এলেন, দেখলেন, তুফান তুলে সবার মন জিতলেন যিনি, তিনিই দিন্দা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলা ৪৪৪-৬ ডি. (শ্রীবৎস ১১২ নটআউট, পঙ্কজ ৯৯), অসম ১-৪ (দিন্দা ৪-০)।