বিরাট আগ্রাসনে সৌরভের ছায়া। —ফাইল চিত্র।
জন রাইট: ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা শুরু হতে আর কতক্ষণ বাকি?
প্রশ্ন: আরও ঘণ্টাখানেক পরে শুরু হবে। আপনি খেলা দেখছেন?
রাইট: হ্যাঁ, কাল দেখেছি। আজও দেখব। ম্যাচটা কিন্তু খুব আকর্ষণীয় জায়গায় চলে যেতে পারে।
প্র: এটাকে কি আপনার পূর্বাভাস ধরা যায় যে, ম্যাচ ফিফটি-ফিফটি?
রাইট: অবশ্যই ধরতে পারেন। ম্যাচ ফিফটি-ফিফটি (তখনও দ্বিতীয় দিনের খেলা শুরু হয়নি)। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম দিনে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু ওরাও সহজে ছেড়ে দেয়নি। এই পিচে ব্যাটিং মোটেও সহজ হচ্ছে না। যত সময় যাবে তত ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা আরও কঠিন হবে। আমার তো মনে হচ্ছে, মিচেল স্টার্কের হাফ সেঞ্চুরিটাই না খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
প্র: টিভি-তে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া দেখতে দেখতে ২০০১ সালের সেই ঐতিহাসিক সিরিজ মনে পড়ে যাচ্ছে না?
রাইট: খুবই মনে পড়ছে। কী দুর্ধর্ষ একটা সিরিজ জিতেছিলাম আমরা! আর, কলকাতায় সেই টেস্ট, উফ্! ক্রিকেটের ইতিহাসেই তো অমর হয়ে থাকল ইডেনের সেই টেস্ট ম্যাচটা।
প্র: কলকাতার সেই ঐতিহাসিক টেস্টের কতটা মনে আছে আপনার?
রাইট: কী বলছেন! প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনে আছে। আমি এখনও বল-বাই-বল কমেন্ট্রি করে যেতে পারি। এই তো লাঞ্চ হল, রাহুল আর লক্ষ্মণ নট আউট হিসেবে ফিরছে। পুরো ড্রেসিংরুম ওদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে দিচ্ছে। ওদের উৎসাহিত করছে। তার পর, এই তো চা-পানের বিরতি হল। এখনও ওরা নট আউট। পুরো ড্রেসিংরুম গমগম করছে। শেন ওয়ার্ন-কে কব্জির মোচড়ে স্পিনের বিরুদ্ধে চার মেরে দিল লক্ষ্মণ। এ রকম মেরেই চলল এর পর। কী জানতে চান বলুন। সব গড়গড় করে বলে যাব। একটাও মুহূর্তও ভুলিনি।
প্র: লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সেই সারা দিন ধরে ব্যাট করে যাওয়াটা কি এখনও অলৌকিক মনে হয়?
রাইট: সারা দিনে একটাও উইকেট না পড়াটা আর কখনও টেস্ট ক্রিকেটে ঘটেছে বলে শুনিনি। দু’জন গ্রেট ব্যাটসম্যান সে দিন ক্রিজে ছিল। ব্যাটিংকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। আমি আজও লক্ষ্মণ-রাহুল আর সেই সঙ্গে আমাদের গোটা দলকে কৃতিত্ব দিয়ে বলতে চাই, থ্যাঙ্ক ইউ বয়েজ। এ রকম চিরস্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
প্র: লক্ষ্মণ-রাহুলের সেই ইনিংস দু’টো নিয়ে ভাবলে কী মনে হয়?
রাইট: সারা জীবনে আমার দেখা অন্যতম সেরা দু’টো ইনিংস। আমরা চাপে ছিলাম। ফলো-অন করছিলাম। তার মধ্যেও যে ভাবে পাল্টা আক্রমণ করে খেলাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল দু’জনে, চিরকালের জন্য প্রাপ্তি হয়ে থাকল।
প্র: ফলো-অন করার পরে লক্ষ্মণকে তিন নম্বরে পাঠানোর সিদ্ধান্তটা ক্রিকেটের লোকগাথায় ঢুকে গেল। আপনার কোচিং জীবনে এটাই কি সর্বসেরা সিদ্ধান্ত?
রাইট: অন্যতম সেরা তো বটেই এবং সবচেয়ে স্মরণীয়। তবে সিদ্ধান্তটা আমি একা নিইনি। লক্ষ্মণ ইডেন টেস্টের প্রথম ইনিংসে দারুণ ব্যাট করল। ড্রেসিংরুমে তখনও ও প্যাড পরে বসা। আমি, সৌরভ আর লক্ষ্মণ মিলে আলোচনায় বসলাম। লক্ষ্মণ নিজে খুব উৎসাহী ছিল। সেটা দেখে সাহস পেয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন হিসেবে সৌরভই ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার শেষ মালিক। তবে লক্ষ্মণকে তিনে পাঠানোর ব্যাপারটা আলোচনার মাধ্যমে সকলে মিলে ঠিক করা।
প্র: সিদ্ধান্তটার পিছনে কি কোনও নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি ছিল?
রাইট: ছিল। ফলো-অন করার পরে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, অস্ট্রেলিয়াকে এক্ষুনি পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। না হলে সিরিজ থেকেই আমরা ছিটকে যাব। দুর্ধর্ষ বোলিং আক্রমণ ছিল ওদের। ম্যাকগ্রা, গিলেসপি, ওয়ার্ন! মুম্বইতে প্রথম টেস্টে আমরা হেরেছিলাম। ইডেনে ফলো-অন করে চাপে। তখনই ড্যামেজ কন্ট্রোল শুরু করতে হতো। লক্ষ্মণ যে হেতু ভীষণ কর্তৃত্ব নিয়ে প্রথম ইনিংসটায় ব্যাট করেছিল, মনে হয়েছিল ওকে দিয়েই পাল্টা চাপে ফেলা যেতে পারে অস্ট্রেলীয় বোলিংকে। ষোলো বছর পরেও এটা ভেবে আনন্দ পাই যে, আমাদের সেই রণনীতিটা একদম সঠিক ছিল।
প্র: ইডেন-জয় এবং তার পর চেন্নাইতে জিতে অস্ট্রেলিয়াকে পর্যুদস্ত করা। ভারতের কোচ হিসাবে এটাই কি আপনার সেরা জয় ছিল?
রাইট: আমি যুগ্ম ভাবে দু’টো সিরিজকে সেরা বাছব। স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই সিরিজের পাশাপাশি রাখতে চাই পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানকে হারানোর গৌরবকে। চোদ্দো বছর পরে পাকিস্তানে গিয়েছিল ভারত। আর কখনও কোনও ক্রিকেট সিরিজকে কেন্দ্র করে এতটা আবেগ চড়তে দেখিনি আমি। দু’টো দেশের সব মানুষ মনে হয় সেই সময় শুধুই ওই সিরিজটা নিয়ে কথা বলছিল। পাকিস্তানে সেই প্রথম কোনও ভারতীয় দল টেস্ট সিরিজ জিতল। সিরিজ জেতার পরে যে রকম অভিনন্দন বার্তা এসেছিল ভারত থেকে, তা থেকেই পরিষ্কার ছিল, নজিরবিহীন কিছু একটা ঘটিয়েছি আমরা। ওটাও খুব বড় সিরিজ ছিল।
প্র: অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই সিরিজ জয়ের প্রধান কারণ হিসাবে কোনটাকে বেছে নিতে চাইবেন?
রাইট: ছেলেদের দুরন্ত ক্রিকেট আর হার-না-মানা মানসিকতাকে বেছে নেব। পিছিয়ে পড়েও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন একটা দলের বিরুদ্ধে পরপর দু’টি টেস্ট জিতে সিরিজ ছিনিয়ে নেওয়াটা বলিষ্ঠতম পারফরম্যান্স। আর একটা জিনিস বলতে চাই। আমরা ওই সিরিজটার জন্য খুব ভাল প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। সিরিজের ঠিক আগেই কুম্বলে ছিটকে গেল। আমরা একটা ক্যাম্প করেছিলাম। সেখানে ক্যাপ্টেন সৌরভ আমাকে নিয়ে গিয়ে হরভজনকে দেখাল। সৌরভ খুবই উত্তেজিত ছিল হরভজনকে নিয়ে। কুম্বলের বদলি হিসেবে ওকেই প্রধান বোলিং-অস্ত্র হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল সৌরভ। আর সেটা যে মোটেও ভুল ভাবনা ছিল না, তা তো কয়েক দিনের মধ্যেই ভাজ্জি প্রমাণ করে দিল। সৌরভ তখন নতুন ক্যাপ্টেন হয়েছে। ভাল কিছু করে দেখানোর তীব্র ইচ্ছেটা আমি ওর চোখে দেখতে পেতাম। টিমের মধ্যে দারুণ স্পিরিট তৈরি হয়েছিল। কুম্বলে যেমন চোটের জন্য সিরিজটায় খেলেনি। কিন্তু সারাক্ষণ বাইরে থেকে আমাদের দলের স্পিনারদের সাহায্য করে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
ওরা যে এক নম্বর টেস্ট দল, দেখিয়ে দিক বিরাটরা
প্র: সচিন, রাহুল, সৌরভ, লক্ষ্মণদের কোচ ছিলেন। এখনকার তারকা বিরাট কোহালিকে কেমন লাগে? কোহালির সঙ্গে সচিনের তুলনা নিয়ে কী বলবেন আপনি?
রাইট: আমার মনে হয় এখনই তুলনায় যাওয়াটা তাড়াহুড়ো করা হয়ে যাবে। সেটা করলে সচিনের অবিশ্বাস্য প্রাপ্তির প্রতি সঠিক সম্মান দেখানো হবে না। আবার বিরাটের ওপরও অনর্থক চাপ তৈরি করা হবে। আমি খুব মন দিয়ে বিরাটের ব্যাটিং দেখছি। দারুণ উন্নতি করেছে ও। নিজের ব্যাটিংকে অনেক উঁচু স্তরে নিয়ে গিয়েছে। ক্রিকেটের অনেক উচ্চ শৃঙ্গেই হয়তো ও আরোহণ করবে। কিন্তু এখনই বড় বড় সব নামের সঙ্গে তুলনায় না গিয়ে ক্রিকেটভক্তদের বলব, আসুন, আমরা ওর ব্যাটিংটা উপভোগ করি। তুলনা করার জন্য অনেক সময় তো পড়েই আছে।
প্র: কেউ কেউ অধিনায়ক বিরাটের আক্রমণাত্মক ভঙ্গির মধ্যে আপনার ক্যাপ্টেন সৌরভের মিল খুঁজে পায়।
রাইট: এই মিলটা কিন্তু আমিও পাচ্ছি। অধিনায়ক বিরাটের আগ্রাসী মনোভাবের মধ্যে আমি সৌরভের আবেগকে খুঁজে পাই। দু’জনেই মাঠের মধ্যে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করায় বিশ্বাসী। সৌরভ খুবই আবেগ দিয়ে ক্যাপ্টেন্সি করত। ফাইটার ছিল। বিরাটের নেতৃত্ব দেওয়ার ধরনটাও অনেকটা একই রকম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy