Advertisement
E-Paper

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আদালতেও জয়ের গন্ধ পাচ্ছে কোহলিরা

সেকেন্ড দিনের খেলা শেষ হয়েছে কি না, মিডিয়া বক্সে কফি মেশিন বন্ধ। জল নেই। এসি কখনও কাজ করছে, কখনও না। কেউ কেউ বুদ্ধিদীপ্ত অনুমানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, আলোও যে কোনও সময়ে চলে যেতে পারে। তখন ল্যাপটপের নিজস্ব আলোয় লিখতে হবে।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৭
দিনের সেরা বলে দুমিনিকে ফেরালেন উমেশ। দেশের মাটিতে রাহানের প্রথম সেঞ্চুরি-হুঙ্কার।

দিনের সেরা বলে দুমিনিকে ফেরালেন উমেশ। দেশের মাটিতে রাহানের প্রথম সেঞ্চুরি-হুঙ্কার।

সেকেন্ড দিনের খেলা শেষ হয়েছে কি না, মিডিয়া বক্সে কফি মেশিন বন্ধ। জল নেই। এসি কখনও কাজ করছে, কখনও না। কেউ কেউ বুদ্ধিদীপ্ত অনুমানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, আলোও যে কোনও সময়ে চলে যেতে পারে। তখন ল্যাপটপের নিজস্ব আলোয় লিখতে হবে।

স্থানীয় একজনকে অভিযোগ জানাতে সে বলল, ডিডিসিএ! ভুলে গেলেন নাকি। আপনাকে যে কোনও কিছুর জন্য যে কোনও সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। কোটলা মাঠটা ঐতিহাসিক ভাবে এদেরই দায়িত্বে। দিল্লি ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্বের সবচেয়ে নিন্দিত ক্রিকেট সংস্থা। অতীতে অনেকেরই মনে হয়েছে রাজঘাট আর এই মাঠটা ভৌগলিক অবস্থানে এত কাছাকাছি হল কী করে? একটা শান্তি, নৈঃশব্দ আর গভীরতার প্রতীক। আর একটা ঠিক ততটাই ঘুণ ধরা, ক্লেদাক্ত, কর্কশ ক্যাঁচরম্যাঁচর সমন্বিত শাসন ব্যবস্থা।

অথচ ভেবে দেখছিলাম, ভারতের বরণীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোকে যদি দেশের বিখ্যাত সৌধগুলোর সঙ্গে সেই সব মাঠের কীর্তি অনুযায়ী মেলানো যায়, কোটলার সঙ্গে ভাল নামই জুড়বে!

তাজমহল অবশ্যই জলের তলায় এখন ডুবে থাকা চিপক। ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে পয়মন্ত মাঠ।

লালকেল্লা ঐতিহাসিক তাৎপর্যের জন্য ব্রেবোর্ন স্টেডিয়াম।

কুতুব মিনার হল ইডেন গার্ডেন্স।

এর পরেই কিন্তু কোটলা। আগ্রা দুর্গের মতোই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এক কাঠামো!

ডিভিডি করে সম্ভ্রমে রেখে দেওয়ার মতো কত কিছু ঘটেছে কোটলায়। একজন জীবন্ত ডিভিডি তো কমেন্ট্রি করতে করতে বারবার আসছিলেন প্রেসবক্সের আড্ডায়। তিনি অনিল কুম্বলে। সেই দশ উইকেটের বলটা আর স্টাম্প যে আজও বাড়ির ট্রফি রাখার ঘরে সাজানো এ দিন বলছিলেন। আর এক জন ডিভিডিও একটু দূরে। সুনীল গাওস্কর। কোটলাতেই তো তাঁর মার্শাল পিটিয়ে সেঞ্চুরি আর ব্র্যাডম্যানকে ধরা! কোটলা আপাতত এখানে না থাকা সচিন তেন্ডুলকরেরও স্মৃতিস্তম্ভ।

এই মাঠের জ্বলন্ত সব ইতিহাসের টুকরোয় মনে হচ্ছে রোববারের মধ্যে আরও একটা সংযোজন হবে। প্রমাণ হবে দু’হাজার পনেরো সালে উইকেটের হাল নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি টিম ইন্ডিয়া এখানেই করে দেয়! প্রমাণ করে দেয় যে, স্টিভ ওয়-র সেই বিশ্বজয়ী টিমকে হারানোর পনেরো বছর বাদের সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ অভিজ্ঞানে কোনও জোচ্চুরি ছিল না।

কোটলার এই টেস্ট যেন ক্রিকেটের অঘোষিত সুপ্রিম কোর্টই হয়ে গিয়েছে যে এখানকার ডিভিশন বেঞ্চে শেষ বিচার হবে, ভারতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্যি কি না? সত্যি তারা উইকেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বের এক নম্বর টিমের থেকে সিরিজ কেড়ে নিয়েছে?

মহামান্য সর্বোচ্চ ক্রিকেট আদালতের আনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণা এখনও বাকি। কিন্তু এ দিন বাদীপক্ষ যে ভাবে পর্যদুস্ত, মনে হয় না আর উঠে দাঁড়িয়ে মামলা জিতবে বলে! ৫০ ওভারও ব্যাট করতে না পেরে তারা ফলো অন করেছিল। টেস্ট তখন সেই তিন দিনেই শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্কেত দেখাচ্ছে। টিভি ভাষ্যকাররা কে কবে বাড়ি ফিরবেন, তার ছক কষছেন।

হঠাৎ দেখা গেল কোহলি ফলো অন করালেন না। না করানোর অর্থ— আমলার টেবলে চতুর্থ ইনিংসে সাড়ে চারশোর ফাইল পাঠাতে চাইছেন। সেই চ্যালেঞ্জে অতিথিদের উদ্ধার করবে কে? ডে’ভিলিয়ার্স ছাড়া বাকিদের দেখে পরিষ্কার মনে হচ্ছে কবে দেশে ফেরার বোর্ডিং কার্ড হাতে পাবেন তার অধীর অপেক্ষায়।

স্পিন এত দিন তাদের ঘাতক ছিল। আজকেও রবীন্দ্র জাডেজা নাচালেন তাদের। কিন্তু তারও আগে তারা তো আধমরা হয়েই ছিল ভারতীয় পেসারদের দাপটে। বল তেমন পুরনো হয়নি অথচ এতটা করে রিভার্স সুইং রোজ রোজ ঘটে না। উমেশের যে বলটায় দুমিনি বোল্ড হলেন সেটাই হয়তো সিরিজের সেরা ডেলিভারি। অশ্বিন বা জাডেজার কোনও ঘূর্ণি নয়। হাসিম আমলা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এত রান করেছেন গত ক’বছর। ব্যাটসম্যান তো নন, যেন রানের লুঠেরা! তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কনফিডেন্স ফেরাতে মনোবিদ লাগবে। ৩৪ বল খেলে করেছেন ৪। দু’প্লেসি আবার সেই চামচে করে তুলতে গিয়ে যে ভাবে আউট সেটা হ্যান্সির আমলে ঘটলে তদন্ত শুরু হয়ে যেত। দু’প্লেসি এত বছর সিএসকে খেলেছেন। ভালই জানেন ঘূর্ণি পিচ। ভালই জানেন অশ্বিনকে। তাঁরও এমন স্পিন-কয়েদি হয়ে যাওয়ার একটাই ব্যাখ্যা, বোলিংয়ে এমন চাপ তৈরি করছে কোহলির ভারত যে, বিশ্বের এক নম্বর টিমের কোনও উত্তর থাকছে না।

আজকের সাংবাদিক সম্মেলনে তো দক্ষিণ আফ্রিকান রিপোর্টাররাই তাঁদের কোচকে তুলোধোনা করছিলেন যে, আমরা কি হারার আগেই হেরে গিয়েছি? ডিডিসিএ-র দখল নিয়ে আপাতত কেজরীবালের নেতৃত্বে আম আদমি পার্টির সঙ্গে অরুণ জেটলির অধিনায়কত্বে বিজেপির যে লড়াই চলছে, তা মোটেই এমন একপেশে নয়। ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো নির্বিরোধী মানুষ যাঁর সম্পর্কে টিভি প্রযোজকের হালকা অনুযোগ, গাঙ্গুলির মতো বলিষ্ঠ হন না। তিনি অবধি বলে দিলেন, ‘‘দূর এই টিমটা মেন্টালি চোক করে গিয়েছে।’’

ডিডিসিএ কর্তা চেতন চৌহান এখন দেখা হলেই পুরনো ওপেনিং পার্টনার গাওস্করকে জড়িয়ে ধরেন। বন্ধু এসো। বুকে এসো। আর কত দিনই বা আছি। চৌহানের যুক্তি, ৬৫ পেরোলেই মানুষ ম্যান্ডেটরি ওভারে ঢুকে যায়। তার পর যে কোনও দিন ঝপ করে আম্পায়ারের আঙুল উঠে যাবে। গাওস্কর খুব আমোদিত হন বলে মনে হয় না। অথচ চৌহানকে দেখলে মনে হয় যেন নীরব অপেক্ষায় আছেন কখন একটা বল অতর্কিতে লাফাবে?

কোটলা যেমন শুক্রবারের দুপুরে অধৈর্য প্রতীক্ষায় বসেছিল কখন বল লাফাতে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানদের মৃত্যুদূত হবে? সহবাগ যেমন শ্রীনিকে তাঁর বক্তৃতায় ধন্যবাদ দিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন যে, ধোনি ব্রাত্য হলে শ্রীনির নাম মনোহরের আগে কেন? তেমনই সফরকারীরা বিস্ময় তৈরি করল ইমরান তাহির আর মর্কেল নিয়েও ভারতের অপরাজিত জুড়ির ওপর কোনও চাপ তৈরি করতে না পেরে। অজিঙ্ক রাহানে আর অশ্বিন মিলে সিরিজের সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ করলেন ৯৮ রানের। রাহানে করলেন সিরিজের প্রথম সেঞ্চুরি।

ভাবতে কেমন লাগে! এই মাঠ তিন বছর আগে টেস্ট ক্রিকেটে রাহানের অভ্যূদয়ে বিষাক্ত ফণার মতো দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা-মা’র সামনে শুধু রান করতে ব্যর্থই হননি, মিচেল জনসনদের শর্ট পিচড বোলিংয়ের বিরুদ্ধে যে টেকনিক দেখিয়েছিলেন তার পর কোনও ক্রিকেট জ্যোতিষীর তাঁর ওপর ভরসা থাকার কথা নয়। সবার প্রথমে যিনি ভরসা হারিয়েছিলেন তাঁর নাম নাকি অধিনায়ক ধোনি।

শোনা যায় এর পর রাহানেকে নিয়ে পড়েন প্রবীণ আমরে। আর আপাতত তাঁর ব্যাটিং-গার্জেন হলেন রবি শাস্ত্রী। দেশের মাঠে মাত্র ৮ গড় ছিল রাহানের। এ দিনের সেঞ্চুরির পর সেটা দাঁড়িয়েছে ২২। কিন্তু অঙ্ক তো আস্ত গাধা। একই মাঠ বিপর্যয় থেকে তাঁর উত্তরণ এবং মেঘে টেক অফ করে যাওয়া দেখল।

ইতিহাস তো এ ভাবেই তৈরি হয়। সে জন্যই ডিডিসিএ-ঘা বুকে নিয়েও কোটলা বরণীয় আর রোববারের মধ্যে তো আরও বড় দলিলের অংশীদার হতে যাচ্ছে। আগেই তো লিখলাম।

কোটলার স্কোর

ভারত
প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৩১-৭)

রাহানে ক ডে’ভিলিয়ার্স বো তাহির ১২৭

অশ্বিন ক ডে’ভিলিয়ার্স বো অ্যাবট ৫৬

উমেশ ন.আ. ১০

ইশান্ত এলবিডব্লিউ অ্যাবট ০

অতিরিক্ত ১২

মোট ৩৩৪।

পতন: ৩০, ৬২, ৬৬, ১৩৬, ১৩৮, ১৩৯, ১৯৮, ২৯৬, ৩৩৪।

বোলিং: মর্কেল ২৪-৫-৫৮-০, অ্যাবট ২৪.৫-৭-৪০-৫,

পিয়েড ৩৮-৬-১১৭-৪, তাহির ১৬-২-৬৬-১,

এলগার ১১-০-৩৩-০, দুমিনি ৪-০-১২-০।

দক্ষিণ আফ্রিকা

প্রথম ইনিংস

এলগার ক ঋদ্ধিমান বো উমেশ ১৭

বাভুমা বো জাডেজা ২২

আমলা ক ঋদ্ধিমান বো জাডেজা ৩

ডে’ভিলিয়ার্স ক ইশান্ত বো জাডেজা ৪২

দু’প্লেসি ক রাহানে বো জাডেজা ০

দুমিনি বো উমেশ ১

ভিলাস বো ইশান্ত ১১

অ্যাবট এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৪

পিয়েড ক রাহানে বো জাডেজা ৫

মর্কেল ন.আ. ৯

তাহির ক লোকেশ (পরিবর্ত) বো অশ্বিন ১

অতিরিক্ত

মোট ১২১।

পতন: ৩৬, ৪০, ৫৬, ৬২, ৬৫, ৭৯, ৮৪, ১০৩, ১১৮।

বোলিং: ইশান্ত ১২-৫-২৮-১, উমেশ ১২-৩-৩২-২,

অশ্বিন ১৩.৩-৫-২৬-২, জাডেজা ১২-২-৩০-৫।

ছবি: প্রেম সিংহ এবং এএফপি।

rahane jadeja india south africa test
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy