Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
কেরল ব্লাস্টার্স- ১ (৩) (সেরেনো) : এটিকে-১ (৪) (রফি)

‘লর্ডসের মতো শুধু জামাটাই খুলল না সৌরভ’

জুয়েল রাজার শটটা গোলে ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে শূন্যে একটা লম্বা লাফ। মুষ্টিবদ্ধ দু’টো হাত উঠে গেল আকাশে। গ্যালারিতে কে নেই তখন? অমিতাভ বচ্চন বসে। নীতা অম্বানী বসে। দেখলাম হাসছেন, হাততালি দিচ্ছেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়কের প্রতিক্রিয়া দেখে।

কোচির মাঠে বজবজের জুয়েল। রবিবারের নায়ক এই বঙ্গসন্তানই। ছবি: পিটিআই

কোচির মাঠে বজবজের জুয়েল। রবিবারের নায়ক এই বঙ্গসন্তানই। ছবি: পিটিআই

দীপেন্দু বিশ্বাস
কোচি শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:১৯
Share: Save:

জুয়েল রাজার শটটা গোলে ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে শূন্যে একটা লম্বা লাফ। মুষ্টিবদ্ধ দু’টো হাত উঠে গেল আকাশে।

গ্যালারিতে কে নেই তখন? অমিতাভ বচ্চন বসে। নীতা অম্বানী বসে। দেখলাম হাসছেন, হাততালি দিচ্ছেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়কের প্রতিক্রিয়া দেখে।

ঠিক ধরেছেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাই বলছি!

ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছে বহু দিন। কিন্তু সৌরভের প্যাশনটা এখনও যা দেখলাম, ভোলা সম্ভব নয়। ওর আবেগ, একশো কুড়ি মিনিট ধরে লাগাতার ছটফটানি দেখলে কে বলবে মাঠে যে খেলাটা হচ্ছে তার নাম ফুটবল, ক্রিকেট নয়! এটিকে জেতার পর সৌরভের আবেগ দেখে মনে হচ্ছিল, জায়গাটার নামই যা কোচি, আর জামাটাই যা খুলল না। বাকিটা তো পুরো যেন ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়ের লর্ডস!

ওই আবেগ দেখতে দেখতে হঠাৎই আরও একটা জায়গায় চোখ চলে গেল। একটা মুখের দিকে। থমথমে। বিষণ্ণ। কোনও ভারতীয়রই যা দেখতে ভাল লাগবে না। লোকটার নাম সচিন তেন্ডুলকর! আবারও এটিকে-কে আইএসএল ফাইনালে পেল সচিনের কেরল। কিন্তু আবারও পারল না। খারাপই লাগছিল সচিনের জন্য। কেরল সেমিফাইনালটা জিতল টাইব্রেকারে। তিনটে নিখুঁত গোল করল সে দিন। আর আজ কি না টাইব্রেকারে হিউমের শট আটকে দিয়েও ওদের জেতা হল না!

আসলে কলকাতা একশো কুড়ি মিনিটেই ম্যাচটা জিতে গিয়েছিল। টাইব্রেকারটা আদতে মানসিক যুদ্ধ। কে কতটা মানসিক ভাবে পোক্ত থেকে ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ বার করছে। কেরল সেখানে দেখল, নিজেদের মাঠে একশো কুড়ি মিনিট খেলেও এটিকে-কে সরাসরি হারাতে পারল না। উল্টে দেখল, ঘরের মাঠে কী ভাবে ঘরের টিমের উপর দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে এটিকে। চাপ তৈরি করছে প্রতি মুহূর্তে। কোচ জোসে মলিনার দু’টো মুভের কথা এখানে বিশেষ করে বলব। প্রথমত, পেরিরাকে তুলে নিয়ে বঙ্গসন্তান প্রবীর দাসকে নামিয়ে দেওয়া। দুই, পস্টিগাকে তুলে জাভি লারাকে নামিয়ে দেওয়া। পস্টিগা-হিউম জুটি যে আতঙ্কটা ছড়াতে পারছিল না, সেটা হিউম-লারা জুটি করে গেল। খালি চোখে দেখলে হয়তো মনে হবে, কী এমন ফাইনাল হল? মাত্র দু’টো তো গোল। তা-ও সেট পিস থেকে। কিন্তু ফুটবলটা একটু-আধটু খেলেছি বলে বলতে পারি, ষাট হাজার দর্শকের সামনে এটিকে যে ভাবে কাপ নিয়ে গেল তার রোমাঞ্চ কিছু কম নয়। ভাবুন তো, ফাইনালে আপনি মার্কি পস্টিগাকে তুলে নিচ্ছেন? কতটা দুঃসাহসী হলে একজন কোচ এটা করতে পারে?

মলিনা যে সাহসটা দেখালেন, স্টিভ কপেল তার অর্ধেকও দেখাতে পারলেন না। আমি তো বুঝেই পেলাম না, কোন যুক্তিতে উনি সন্দীপ নন্দীকে টিমে রাখলেন না? যে গোলকিপার টাইব্রেকারে পেনাল্টি বাঁচিয়ে ফাইনালে তুলল টিমকে, আসল ম্যাচে কি না সে-ই নেই! এটা তো ঘটনা যে, টাইব্রেকে উল্টো দিকে সন্দীপকে দেখলে চাপে পড়ত এটিকে। কে বলতে পারে, সচিনের মুখে তখন সৌরভের হাসিটা থাকত না?

যাক গে। যা হয়নি, হয়নি। এটিকে-তে ফিরি। মলিনাকে নিয়ে বলছিলাম। এ বার তিন বাঙালিকে নিয়ে বলি। জুয়েল রাজা। প্রীতম কোটাল। দেবজিৎ মজুমদার। ডিফেন্সে অর্ণব মণ্ডল ছিল না। কিন্তু প্রীতম সেটা বুঝতে দেয়নি। ডাবল চাপ নিয়ে আগাগোড়া খেলে গেল। দেবজিৎ তো আইএসএলের সেরা গোলকিপার। মলিনাকে কিন্তু এক দিক থেকে আইএসএল দিয়ে গেল দেবজিতই। রবিবারও গোটা তিনেক ভাল সেভ করেছে। জুয়েলের কথাও বলতে হবে। মাঝমাঠে বোরহার সঙ্গে স্কিমারের কাজটা দারুণ করেছে। আর টাইব্রেকে শেষ শটটাও দুর্দান্ত রেখেছে। ট্রফির লক্ষ্যে নেওয়া হয় যে শট, তা কিন্তু সহজ হয় না। জুয়েলকে দেখে মনে হয়নি, শটটা নেওয়ার সময় ও কোনও চাপে ছিল।

জুয়েল চাপে না থাকতে পারে, কিন্তু ওর মালিকরা ভাল রকম ছিল। ম্যাচ চলার সময় দেখছিলাম, এটিকে মালিক সঞ্জীব গোয়েন্কা বারবার পকেট থেকে ইষ্টদেবতার ছবি বার করে প্রণাম করছেন। সৌরভকে দেখছিলাম, কামড়ে-কামড়ে নখ প্রায় তুলে ফেলেছে! অমিতাভ বচ্চন নড়ছেন না। এক জায়গায় চুপ করে বসে। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ, টানা। সচিনকে দেখে মনে হল যেন তুকতাক করছে। দশ মিনিট বাদে-বাদে অঞ্জলির (তেন্ডুলকর) সঙ্গে সিট পাল্টাচ্ছে! নীতা অম্বানিকেও দেখলাম, এক জায়গায় বসে থাকতে পারছেন না। মাঝে-মাঝেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছেন।

স্বাভাবিক। কেরল গোল করে এগিয়ে যাওয়ার সাত মিনিটের মধ্যে গোল শোধ। তার পর নির্ধারিত সময়, একস্ট্রা টাইম, সব পেরিয়ে টাইব্রেকারে ট্রফির ফয়সলা। টেনশন হবে না এর পর? রাতে টিম হোটেলে ঢোকার সময় জোসে মলিনার সঙ্গে দেখা হল। কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল, লোকটা যেন ফাইনাল নয়। জীবন-মৃত্যুর একটা ম্যাচ খেলে উঠেছেন! বারবার বলছিলেন, প্রবীর-জুয়েল-দেবজিৎ অসাধারণ খেলল। হ্যাটস অফ।

ঠিকই তো। তিন বঙ্গসন্তানের হাত ধরেই তো আবার আইএসএল কলকাতার।

সরি, বাংলার। বাঙালির!

এটিকে: দেবজিৎ, প্রীতম, সেরেনো (নাতো), তিরি, পেরেরা (প্রবীর), বোরহা, লালরিন্দিকা, জুয়েল, দ্যূতি, পস্টিগা (লারা), হিউম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jewel Raja Atletico de Kolkata ISL 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE