Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জঙ্গিদের বিভ্রান্ত করেই হামলা মায়ানমারে, দাবি সেনার

মায়ানমারের জঙ্গল-ঘাঁটিতে থাকা খাপলাং জঙ্গিদের বিভ্রান্ত করতেই কি ভুল বিবৃতি দিয়েছিল এনআইএ? এমন জল্পনাই উস্কে দিল সেনাবাহিনী। মণিপুরে সেনা কনভয়ে জঙ্গিহানার তদন্ত শুরুর পর এনআইএ জানিয়েছিল, হামলার ষড়যন্ত্র কষেছিল তিন জন— খাপলাং বাহিনীর প্রধান খাপলাং, দলের সাধারণ সম্পাদক মুলাতনু, প্রচারসচিব চাকেসাং। সেই বিবৃতি নিয়ে বিভিন্ন শিবির প্রশ্ন তোলে।

ছবি পিটিআই।

ছবি পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ১৮:০৯
Share: Save:

মায়ানমারের জঙ্গল-ঘাঁটিতে থাকা খাপলাং জঙ্গিদের বিভ্রান্ত করতেই কি ভুল বিবৃতি দিয়েছিল এনআইএ? এমন জল্পনাই উস্কে দিল সেনাবাহিনী।
মণিপুরে সেনা কনভয়ে জঙ্গিহানার তদন্ত শুরুর পর এনআইএ জানিয়েছিল, হামলার ষড়যন্ত্র কষেছিল তিন জন— খাপলাং বাহিনীর প্রধান খাপলাং, দলের সাধারণ সম্পাদক মুলাতনু, প্রচারসচিব চাকেসাং। সেই বিবৃতি নিয়ে বিভিন্ন শিবির প্রশ্ন তোলে। খাপলাং-এর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ওই দুই নেতা যে গত বছরই জঙ্গি শিবির ছেড়ে সংঘর্ষবিরতি করেছেন!
সেনা সূত্রে খবর, খাপলাং জঙ্গিদের বিভ্রান্ত করতেই ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সুযোগেই গত কাল মায়ানমারে খাপলাং বাহিনীর দু’টি শিবিরে হামলা চালানো হয়। শিবিরগুলির হদিস দিয়েছিল খাপলাংয়ের পুরনো ‘বন্ধু’রাই। তাদেরই এক জন, ওয়াংতিং কন্যাক সেনাবাহিনীকে এই অভিযানে সাহায্যও করেছে।
সেনা সূত্রে খবর, গত কাল মণিপুরের চাণ্ডেল ও নাগাল্যান্ডের তুয়েনসাং জেলার লাগোয়া মায়ানমার সীমান্তে ঢুকে অভিযান চালায় কম্যান্ডো বাহিনী। সেনার ‘টার্গেট’ ছিল নোকলাকের ওনজায় জঙ্গিদের দু’টি শিবির। সেখানে খাপলাং, কেসিপি, কেওয়াইকেএল সংগঠনের শতাধিক জঙ্গি থাকার খবর মিলেছিল। দু’টি এমআই ১৭ হেলিকপ্টার নিয়ে ২১ প্যারা কম্যান্ডো বাহিনী আচমকা হামলা চালায়। পাল্টা জবাব দেওয়ার সময় পায়নি জঙ্গিরা। সেনার প্রাথমিক হিসেবে, নিহতের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি হতে পারে।

উত্তর-পূর্বে মোতায়েন এক সেনাকর্তা বলেন, ‘‘পাঁচ দিন ধরে হামলার ছক কষা হয়। মণিপুরে ভারতীয় বাহিনীর উপর হামলার পরে সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ সে রাজ্যে গিয়েছিলেন। তখন ৩ কোরের কম্যান্ডার ও আসাম রাইফেল্স কর্তাদের সঙ্গে তিনি গত কালের হামলা নিয়ে প্রাথমিক বৈঠক সেরেছিলেন।’’ সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনুমতি পাওয়ার পরই ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের ২১ প্যারা কম্যান্ডোরা হামলার প্রস্তুতি শুরু করেন। তাঁদের সাহায্যে তৈরি ছিল আসাম রাইফেল্স। মায়ানমার সরকারের শীর্ষ মহলে হামলার খবর জানাতে হত। কিন্তু, সে দেশের সেনা বাহিনীকে সরকারি ভাবে আগে ওই তথ্য জানাতে চায়নি ভারতীয় সেনা। তাতে খবর ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা ছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে মায়ানমার সরকারকে সেনা-হামলার বিষয়ে জানায় নয়াদিল্লি।

সেনা সূত্রে খবর, সংঘর্ষবিরতিতে থাকা জঙ্গিদের কাছ থেকে মায়ানমারের খাপলাং বাহিনীর ঘাঁটির মানচিত্র বুঝে নিয়েছিলেন কম্যান্ডোরা। মায়ানমার সীমান্তের ও পারে সে দেশের সেনা বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কার্যত কোনও অস্তিত্ব নেই। সেখানে অনেকটা এলাকায় খাপলাং-এর স্বশাসন চলছে। সেনাকর্তারা খবর পেয়েছিলেন, মণিপুরে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের গত কালই মায়ানমার সীমান্তের জঙ্গলের ঘাঁটিতে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সেখানে হাজির থাকবেন খাপলাং বাহিনীর সেনাপ্রধান ইসাক সুমি, অর্থমন্ত্রী স্টারসন, কেসিপি সভাপতি কে লাবা মেইতেই এবং কেওয়াইকেএল চেয়ারম্যান এন ওকেন। সেখানেই হামলার ছক ছিল সেনাবাহিনীর। কিন্তু, ওনজা ও চাসাডের অন্য দু’টি জঙ্গিশিবিরে হানা দিলেও, জঙ্গিদের সংবর্ধনা সভায় সম্ভবত পৌঁছতে পারেননি কম্যান্ডোরা। ওই সেনাকর্তার মন্তব্য: ‘‘পুরো অভিযান দ্রুত শেষ করতে হয়েছে। তাই মায়ানমার সীমান্তের ও দিকে বেশি ভিতরে ঢোকার সময় মেলেনি।’’

গত রাতেই জঙ্গিদের যৌথ মঞ্চ ভারতীয় সেনার দাবিকে লঘু করে দেখাতে বিবৃতি প্রকাশ করে। জঙ্গিরা জানায়, মণিপুরে ভারতীয় জওয়ানদের উপরে হামলা চালানো জঙ্গিদের সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। ওই সভায় ওকেন, মেইতেই ও স্টারসনও হাজির ছিলেন।

মায়ানমার সীমান্তে ঢুকে হামলার কথা সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী কর্নেল রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌরও। তিনি জানান, জঙ্গিরা মায়ানমারে ঘাঁটি গেড়ে ভারতে নাশকতা চালিয়ে যাবে, তা সহ্য করা হবে না। প্রয়োজনে ফের একই রাস্তা নেওয়া হবে। পাকিস্তানের নাম না করেই তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘ভারতের পশ্চিম সীমান্ত-সহ অন্য কোনও পড়শি দেশের জমিতে ভারত বিরোধী জঙ্গিরা ঘাঁটি গড়লে সেখানেও হানা দিতে পারে ভারতীয় সেনা।’’ তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যতিক্রমী ও সাহসী সিদ্ধান্তের জেরেই মায়ানমারে জঙ্গিঘাঁটিতে অভিযান চালানো গিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের নরমপন্থী ভাবমূর্তি ভেঙে দিতেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে। ওনজায় জঙ্গিদের ‘ট্রানজিট’ শিবিরের কথা সেনাবাহিনী আগেই জানত। জঙ্গিরা ভেবেছিল, রাজনৈতিক স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী ভারত কখনও পড়শি দেশের সীমান্তের পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে হামলা চালাবে না। গত কালের অভিযানে মোদী সরকার মায়ানমারকেও বুঝিয়ে দিল— তারা যদি সে দেশের মাটিতে ভারত বিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপ দমন করতে না পারে, তবে ভারতই সেই দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেবে।

তবে মায়ানমারের ভিতরে ঢুকে ভারতীয় সেনার আক্রমণ এই প্রথম নয়। ১৯৯৫ সালে ‘অপারেশন গোল্ডেন বার্ড’-এর সময়ে ভারতীয় ও মায়ানমার সেনা যৌথ ভাবে অভিযান চালিয়েছিল। ৪৫ দিনের অভিযানে সে বার ৪০ জন জঙ্গি মারা যায়। ১৩০ জন জখম হয়। এর আগে মণিপুরে সেনা অভিযানগুলি হল— ১৯৮৭ সালে ‘ব্লু বার্ড’, ১৯৯৩-এর ‘অপারেশন সানি ভেল’, ২০০৫-এ ‘অপারেশন লোকটাক’ ও ‘অপারেশন টর্নেডো’, ২০০৬-এ ‘অপারেশন ড্রাগনেট ও অপারেশন সোমতাল-১’, ২০০৮-এ ‘অপারেশন সোমতাল-২’ এবং ২০০৯-এ ‘অপারেশন সামার স্টর্ম’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Manipur Myanmar soldiers ambush
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE