Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দাদরির দায় নেবেন না মোদী, বিভাজন নিয়ে দোষ দিচ্ছেন বিরোধীদেরই

ক’দিন আগে বিহারে ভোটপ্রচারে গিয়ে পরোক্ষে মুখ খুলেছিলেন। আর আজ সরাসরি দাদরি নিয়ে মুখ খুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিলেন, ওই ঘটনা তিনি সমর্থন করেন না। কিন্তু বিরোধীদের আক্রমণের সামনে মাথা নিচু করারও কিছু নেই।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:১০
Share: Save:

ক’দিন আগে বিহারে ভোটপ্রচারে গিয়ে পরোক্ষে মুখ খুলেছিলেন। আর আজ সরাসরি দাদরি নিয়ে মুখ খুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিলেন, ওই ঘটনা তিনি সমর্থন করেন না। কিন্তু বিরোধীদের আক্রমণের সামনে মাথা নিচু করারও কিছু নেই। কারণ, ওই ঘটনার দায় তাঁর সরকারের নয়। তাঁর কথায়, ‘‘দাদরির ঘটনা বা পাকিস্তানি সঙ্গীতশিল্পীর বিরুদ্ধাচারণের ঘটনা দুঃখজনক, অনভিপ্রেত। কিন্তু এই ঘটনাগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাটা কী?’’

দাদরির হত্যাকাণ্ড, লেখক এম এম কালবার্গির হত্যা, পাকিস্তানি শিল্পী গুলাম আলিকে মুম্বইয়ে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়া, প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কাসুরির বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যেতে চাওয়ার প্রতিবাদে সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়া— হিংসা ও অসিষ্ণুতার ঘটনাস্রোতের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন, এই অভিযোগ বারবার উঠেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, যে মোদী ছোট-বড় সব ঘটনা নিয়েই টুইটারে মন্তব্যের বন্যা বইয়ে দেন, তার নীরব থাকাটা আসলে বৃহত্তর কৌশলের অঙ্গ। বিহার ভোটকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ উস্কে দিতে চান তিনি ও তাঁর দল।

এ দিন আনন্দবাজারের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে সেই অভিযোগ উড়িয়ে মোদী বলেন, ‘‘বিজেপি কখনওই এই ধরনের ঘটনাকে সমর্থন করে না। এগুলিকে সামনে এনে প্রতিপক্ষরা বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলছেন বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে তাঁরাই কি আসলে মেরুকরণের রাজনীতি করছেন না?’’ মোদীর দাবি, সেই দলগুলিই এ ব্যাপারে প্রচার শুরু করেছে, যারা সংখ্যালঘুর উন্নয়ন চায় না, তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে দেখতে চায়। তিনি বলেন, ‘‘অতীতেও এই বিতর্ক হয়েছে। বিজেপি চিরকাল মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করেছে। আজ এই দুঃখজনক সামাজিক ব্যাধির মুখোমুখি হয়ে আবার সেই বিতর্ক উঠে এসেছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই বিতর্কের নিরসন সম্ভব।’’

বিজেপি সূত্র অবশ্য বলছে, এই ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দেশ জুড়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী, আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব অখুশি নন। কারণ তাঁদের মতে, বিরোধীদের মুখে মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার যে মুখোশ রয়েছে, তা খসে পড়বে। কিছু দিন আগে আমেরিকায় গিয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি দাদরি-কাণ্ড প্রসঙ্গে বলেছেন, এই ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
ভারতে বিদেশি লগ্নির প্রয়োজন মাথায় রেখেই জেটলি পরমত সহিষ্ণুতার আদর্শ তুলে ধরতে চেয়েছেন।

কিন্তু তাঁর সঙ্গে এক মত নয় সঙ্ঘ পরিবার। তারা বলছে, এই ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি কেন ক্ষুণ্ণ হবে? দাদরি কাণ্ডে মোদী সরকার তো জড়িতই নয়। জড়িত নয় বিজেপি-ও। উত্তরপ্রদেশে তাদের সরকারও নেই। কেন্দ্র বরং এ ব্যাপারে রাজ্য
সরকারকে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই বলেছে। বিজেপি-ও আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ঘটনার নিন্দা করেছে। সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি যা বলেছেন, তা বৃহৎ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বলা। এবং রাষ্ট্রপতির নাম করে প্রধানমন্ত্রী সেই বক্তব্যের সমর্থনও জানিয়েছেন।

কিন্তু বিরোধীরা বার বার প্রশ্ন তুলছে, প্রধানমন্ত্রী দাদরি কাণ্ডের পরপরই কেন প্রতিক্রিয়া জানাননি? কেন গুলাম আলি বিষয়টি নিয়েও তিনি কোনও মন্তব্য করেননি? গত কাল সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপে দেওয়ার ঘটনার পরেও তো প্রধানমন্ত্রী কোনও টুইট করেননি! তাঁর কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি একের পর এক সাহিত্যিকের পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া নিয়েও।

বিজেপি সূত্র বলছে, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফেরানো বা অকাদেমি থেকে ইস্তফা নিয়েও সরকার আদৌ উদ্বিগ্ন নয়। বরং স্মৃতি ইরানির মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বা মহেশ শর্মার সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ বিভিন্ন সমিতি থেকে ‘কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ’রা সরে দাঁড়ালে তারা খুশিই হবে। ওই সব পদে দ্রুত নিজেদের পছন্দের লোকেদের
আনতে চাইছে সরকার। এই কারণেই নেহরু কেন্দ্রের প্রধানের পদ থেকে মহেশ রঙ্গরাজনের ইস্তফা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হলেও সরকার এ নিয়ে শুরু থেকে অনমনীয়ই থেকেছে।

ফলে এক দিকে রোমিলা থাপার থেকে শুরু করে নয়নতারা সহগল— মোদীর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে মুখর। অন্য দিকে বিজেপি মনে করছে, বহুত্ববাদের নাম করে নেহরু ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে কাঠামোটি তৈরি করেছিলেন, সেটি বদলানোর একটা সুযোগ ও সময় এসেছে।

মোরারজি দেশাইয়ের সরকারে লালকৃষ্ণ আডবাণী যখন তথ্যমন্ত্রী, তখন দূরদর্শনে ‘স্বয়ংসিদ্ধ’ নামে একটি ছবি দেখানো নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। সেই ছবির কাহিনি ছিল একটি গ্রামে এক হিন্দু পরিবারের গৃহকর্তা মূক ও বধির। পাদ্রিরা এসে তাঁর স্ত্রীকে বলেন, খ্রিস্টান হয়ে গেলে তাঁর স্বামী ভাল হয়ে যাবে। আর গ্রামের পুরোহিত এসে জানান, এই পাদ্রিদের গ্রামছাড়া করলে স্বামী সুস্থ হবে। সেই মতো পাদ্রিদের উপরে আক্রমণ করে ও তাঁদের গ্রামছাড়া করার পরে অসুস্থ লোকটি সেরে ওঠে।

১৯৫০ সালে নির্মিত এই ছবিটি ১৯৭৭ সালে আডবাণী দূরদর্শনে দেখান। আডবাণী তখনও ‘জিন্না-প্রেমী’ হননি। কিন্তু সরকারটা ছিল জনতা পার্টির। বাইরে থেকে বামেদের সমর্থন ছিল। আর জনসঙ্ঘের শক্তি ছিল কম। ফলে তীব্র বিতর্কের মুখে এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের লাইন নিয়ে আর এগনো সম্ভব হয়নি।

এর পর অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছ’বছরের শাসনেও ছিল জোট সরকার। ডিএমকে বা তৃণমূলের মতো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল নিয়ে সরকার চালাতে হচ্ছিল। তখনও বাজপেয়ীর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষা করা ছিল অনেক জরুরি। এ জি নুরানির কথায়, ‘‘তখন বিজেপির আসলে দু’টি মুখ। এক দিকে ছিলেন বাজপেয়ী, অন্য দিকে আডবাণী, উমা ভারতী। কিন্তু এখন নরেন্দ্র মোদী আর মোহন ভাগবত— দু’টি মিলিয়ে একটিই মুখ।’’

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ অবশ্য বলেছেন, ‘‘বিহারে প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের কথাকেই সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা কোথাও সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ তুলছি না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করারও কোনও প্রশ্নই উঠছে না। অথচ আমাদের প্রতিপক্ষরা মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের জন্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলিকে দূরে সরিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক আসামি বানাতে বেশি তৎপর।’’

বিরোধীদের এই প্রচারের মুখে গুটিয়ে যাওয়ার বদলে পাল্টা আক্রমণাত্মক হয়ে মানুষের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। দলীয় নেতারা বলছেন, নরসিংহ রাওয়ের সময় অর্জুন সিংহ যখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তখন কমিউনিস্ট এবং তাদের বন্ধু সংগঠন ‘সহমত’‌কে নিয়ে তিনি বিজেপি-বিরোধী রাজনীতি করেছিলেন। সহমতের কর্মীরা অযোধ্যায় গিয়ে আন্দোলন করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা আজও মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই আক্রমণের পাল্টা হিসেবেই মোদী সরকার সাম্প্রদায়িকতার ঘটনাগুলিতে দুঃখপ্রকাশ করলেও ক্ষমাপ্রার্থী নয়। কারণ, তারা মনে করছে, অযথা আত্মরক্ষামূলক না হয়ে মতাদর্শগত ভাবে এ ব্যপারে আরও বেশি আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রয়োজন।

রোমিলা থাপার অবশ্য বলছেন, আসলে এটা যতটা না ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, তার থেকেও অনেক বেশি ক্ষমতার রাজনীতি। এই ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে শাসক গোষ্ঠী তার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে আরও সুসংহত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অশোক থেকে আকবর— ভারতের পরমত-সহিষ্ণুতার সংস্কৃতিকে এই মনোভাব আগামী দিনে আরও বিপর্যস্ত করবে বলেই তাঁর আশঙ্কা।

রুশদির তোপ

নয়নতারা সহগল-সহ যে সব লেখক সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সোমবার টুইট করেন বুকারজয়ী লেখক সলমন রুশদি। ওই টুইটের জেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা শুরু হয়। যা দেখেশুনে মঙ্গলবার সলমন রুশদির প্রতিক্রিয়া, ‘মোদীর ওই সব তোষামুদের’ মন্তব্যে তিনি পরোয়া করেন না। তাঁর কথায়, ‘‘স্বাধীন চিন্তার উপরে যে কোনও আক্রমণেরই বিরোধিতা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE