Advertisement
E-Paper

রায়পুরের পুরনো বাড়িতে মেরে পুঁতেছি বাবা-মাকে, কবুল উদয়ন দাসের

গোড়ায় বলেছিল প্রেমিকা আমেরিকায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর দেহ মিলেছে ভোপালের সাকেত নগরের বাড়ির মেঝে খুঁড়ে!ধরা পড়ার পরে প্রথমে সে বলেছিল, ২০১০-এ হৃদ্‌রোগে বাবা মারা গিয়েছেন রায়পুর হাসপাতালে। মা রয়েছেন আমেরিকায়।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৬
উদয়ন ও আকাঙ্ক্ষা। —ফাইল চিত্র।

উদয়ন ও আকাঙ্ক্ষা। —ফাইল চিত্র।

গোড়ায় বলেছিল প্রেমিকা আমেরিকায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর দেহ মিলেছে ভোপালের সাকেত নগরের বাড়ির মেঝে খুঁড়ে!

ধরা পড়ার পরে প্রথমে সে বলেছিল, ২০১০-এ হৃদ্‌রোগে বাবা মারা গিয়েছেন রায়পুর হাসপাতালে। মা রয়েছেন আমেরিকায়। লাগাতার জেরার পরে তার স্বীকারোক্তি, বাবা-মায়ের দেহ পোঁতা রয়েছে ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে আগে সে যে বাড়িতে থাকত, তার বাগানে!

আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া উদয়ন দাসের এহেন বয়ানে স্তম্ভিত পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দারাও।

বৃহস্পতিবার আকাঙ্ক্ষার দেহ উদ্ধারের পরেই তাঁর ‘প্রেমিক’ উদয়ন স্বীকার করেছিল খুনি সে-ই। রুটিনমাফিক তদন্তে তার পরিবার পরিজন সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করে স্থানীয় গোবিন্দ নগর থানার পুলিশ। জানতে চাওয়া হয় তার বাবা-মায়ের কথা। গোড়ায় উদয়ন বলে তার বাবা মারা গিয়েছেন, মা রয়েছেন আমেরিকায়। আমেরিকার কোথায়? প্রশ্ন করে পুলিশ। ফোন নম্বর কী? কিছুই ঠিকঠাক বলতে পারেনি উদয়ন। সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে জেরার চাপ। উদয়নের এক মাসিকে থানায় এনে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। শেষে চাপের মুখে ভেঙে পড়ে উদয়ন। কবুল করে ২০১০-’১১ সাল নাগাদ সে মা ইন্দ্রাণী দাস এবং বাবা ডি কে দাসকেও গলা টিপে খুন করে পুঁতে দিয়েছে রায়পুরের তার পুরনো বাড়ির বাগানে।

উদয়নের বয়ান অনুযায়ী, আকাঙ্ক্ষাকে মেরে একটি ট্রাঙ্কের ভিতর পুরে তার ভিতর ১৪ বস্তা সিমেন্ট গোলা ঢেলে দিয়েছিল সে। তার পর মেঝে খুঁড়ে ট্রাঙ্কটি পুঁতে তার উপর বেদি তৈরি করে। সেই বেদির উপরে ঠাকুর-দেবতার ছবি রেখে পুজো-আচ্চাও করতো।

বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও সে প্রায় একই কাজ করেছে বলে জানিয়েছে উদয়ন। পুলিশের একাংশের দাবি, সে বলেছে, বাবা-মাকে খুন করার পরে দেহ দু’টি রায়পুরের বাড়ির বাগানে পুঁতে দেয়। সেখানে মাঝেমধ্যে পুজো দিত। পুলিশের অন্য একটি সূত্র আবার জানাচ্ছে, ওই বাড়ির মেঝে খুঁড়ে বাবা-মায়ের দেহ পুঁতে রাখার কথা বলেছে উদয়ন।

প্রশ্ন উঠেছে, উদয়ন কি তবে ‘সিরিয়াল কিলার’? সে কি মানসিক রোগে আক্রান্ত? অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে আলফ্রেড হিচককের বিখ্যাত ছবি ‘সাইকো’-র কথা। যে ছবিতে মৃতা মায়ের সঙ্গে মানসিক ভাবে বাস করতেন ছেলে। ছবির শেষে একটি সেলারে মেলে পোশাক ও পরচুলা পরা মায়ের কঙ্কাল।

আরও পড়ুন
এই ‘সিরিয়াল কিলার’দের কাহিনী শুনলে শিউরে উঠতে হয়
পড়শির জটলা, তবু দরজা বন্ধই

মনে পড়ছে কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দে-র কথাও। দিদির মৃত্যুর পর তাঁর দেহ বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। তবে দিদিকে অবশ্য পার্থ খুন করেননি।

ভোপাল পুলিশেরও ধারণা উদয়ন মানসিক বিকারগ্রস্ত। তার কারণও রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ভোপালের সাকেত নগরের বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দিত না উদয়ন। বাড়ির যত্রতত্র নোংরা। বাড়িটিতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ কিছু ক্রাইম সিনেমার সিডি উদ্ধার করেছে। পুলিশের দাবি জেরায় উদয়নের স্বীকারোক্তি, ইংরেজি ধারাবাহিক ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ দেখেই সে আকাঙ্ক্ষাকে খুনের ছক কষে। সেই বাড়িতে একটি দড়িও পেয়েছে পুলিশ। তাদের দাবি, উদয়ন জানিয়েছে, প্রথমে সে ঠিক করেছিল, আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে ওই দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেবে। পরে সিদ্ধান্ত বদলে শ্বাসরোধ করে খুন করে।

পুলিশের আরও দাবি, গত তিন মাস জল খায়নি উদয়ন। শুধু বিয়ার আর মদ খেয়েছে। স্নানও করত না। গায়ের গন্ধ ঢাকতে ব্যবহার করত সুগন্ধী! বাইরে বেরোনোর সময় হিজাব পরতো। মন-চিকিৎসকদের মতে, মানসিক এই অসুখের সূত্রপাত সাধারণত হয় ছোটবেলাতেই। সময়মতো সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করা না গেলে তা জটিল আকার ধারণ করে। উদয়নের ক্ষেত্রে সম্ভবত তা-ই হয়েছিল।

কিন্তু আকাঙ্ক্ষা বোধহয় তাঁর ‘প্রেমিকের’ এই বিকৃতি বুঝতে পারেননি। কারণ, এখনও পর্যন্ত যা তথ্য সামনে এসেছে, তাতে আমেরিকা যাওয়ার নাম করে ফেসবুকে আলাপ হওয়া উদয়নের সঙ্গে থাকতে ভোপাল চলে এসেছিলেন তিনি। বাড়ির সঙ্গেও তেমন ভাবে যোগাযোগ রাখেননি। অন্তত যত দিন বেঁচেছিলেন।

পুলিশ সূত্র বলছে, আকাঙ্ক্ষাকে খুন করার পরে উদয়ন আকাঙ্ক্ষার মোবাইল থেকে ‘ভালো আছি’ মেসেজ পাঠিয়ে বোকা বানাচ্ছিল তাঁর বাবা-মাকে। তাঁরাও কেন এত দিন নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলেন, সেই প্রশ্নও অবশ্য উঠেছে। শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে বাঁকুড়া থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন আকাঙ্ক্ষার বাবা শিবেন্দ্র শর্মা। তারই তদন্তে পুলিশ পৌঁছে যায় সাকেত নগরের উদয়নের বাড়িতে। জেরায় উদয়ন জানিয়েছে, পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন আকাঙ্ক্ষা। যা তার পছন্দ ছিল না। তাই আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে।

কিন্তু বাবা-মাকে কেন খুন করল উদয়ন? পুলিশের দাবি, সম্পত্তির লোভে। তাই বাবা-মাকে খুনের পরেই রায়পুরের ওই বাড়ি বেচে দিয়ে ভোপালে চলে আসে সে। শুরু করে বিলাসবহুল জীবনযাপন।

রায়পুরের এই বাড়িতেই বাবা-মাকে মেরে পুঁতে দিয়েছে উদয়ন। ছবি: রূপেশ যাদব।

মা আমেরিকায় আছেন বলে গোড়ায় দাবি করলেও পুলিশের একটি বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, খুনের পরে বাবার সঙ্গে মায়েরও জাল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করেছিল উদয়ন। তাতে দু’জনই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উদয়নের কম্পিউটার ঘেঁটে এই তথ্য মিলেছে।

উদয়ন বাবা-মাকে খুন করার কথা স্বীকার করার পরেই ভোপাল পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ছত্তীসগঢ় পুলিশের সঙ্গে। ভোপাল (দক্ষিণ)-এর পুলিশ সুপার সিদ্ধার্থ বহুগুণা ফোনে বলেন, ‘‘উদয়ন খুবই চালাক ছেলে। আমাদের কাছে জেরায় সে নিজের বাবা ও মাকেও খুন করে রাইপুরের বাড়িতে পুঁতে দিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এর সত্যাসত্য জানা দরকার। সে জন্য শনিবার রাতে পুলিশ উদয়নকে নিয়ে রায়পুরে যাবে। তার পরেই আসল তথ্য উঠে আসবে।’’ ভোপাল পুলিশের সঙ্গে থাকবে বাঁকুড়া পুলিশের একটি দল। পুলিশ সূত্রের খবর, কাল সকালে রায়পুরের ওই বাড়ির মাটি খুঁড়ে দেখা হবে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, ‘‘উদয়নকে নিয়ে শনিবার রাতেই বাঁকুড়া পুলিশের রাজ্যের পথে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। তবে নতুন করে আরও দু’টি খুনের কথা সামনে আসায়, ঠিক কবে তাকে বাঁকুড়ায় আনা যাবে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না।’’

পুলিশি জেরায় উদয়ন আরও জানিয়েছে, দিল্লির ডিফেন্স কোলনি, রায়পুর এবং সাকেত নগরে তার ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখান থেকে সে যথাক্রমে ভাড়া বাবদ ১০ হাজার, ৭ হাজার এবং ৫ হাজার টাকা পেত। কাল উদয়ন বলেছিল, সে দিল্লির একটি আইটিআই কলেজ থেকে পাশ করেছে। কিন্তু এ দিন জানিয়েছে, সে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ। তবে তার সব তথ্যেই খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ ভোপালের এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘উদয়ন খুবই বুদ্ধিমান। লোককে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও মারাত্মক। ইংরেজিতে সড়গড় উদয়ন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিথ্যে বলে।’’

Akanksha murder case Akanksha Sharma Udayan Das Murder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy