নীরব মোদী। ছবি- সংগৃহীত।
১৯ বছর থেকে ৪৬ বছর বয়স। সে ছিল এক ‘ধূমকেতুর উত্থান’-এর কাহিনি!
বংশের রত্ন ব্যবসা দেখাশোনা দিয়ে শুরু করে ২৭ বছরেই তিনি হয়ে পড়েন গোটা দুনিয়ায় ‘সেলিব্রিটি’! হিরের দৌলতে!
তাঁর সংস্থার হিরে গায়ে উঠেছে হলিউডের অনেক নামী, দামি তারকার। আর বিশ্ব জুড়ে তাঁর পসার ছড়িয়ে পড়েছে ধূমকেতুর উত্থানের মতো!
২৭ বছরের একটানা উত্থানের পর ২০১৭ ফুরোতেই ভাগ্যের চাকা তাঁর ঘুরতে শুরু করল উল্টো দিকে। শুরু হল উল্কার পতন!
তিনি নীরব মোদী। যাঁর পূর্বপুরুষরা আদতে গুজরাতের সুরাতের বাসিন্দা হলেও ১৯৭১-এ নীরবের জন্ম হয় বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে। রত্ন ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন নীরবের ঠাকুর্দা কেশবলাল মোদী, গুজরাতের সুরাতে। চারের দশকে ব্যবসার জন্যই পরিবার নিয়ে কেশবলাল চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেই ব্যবসার আরও প্রসার ঘটান নীরবের বাবা দীপক মোদী। ব্যবসার প্রসার, পসারে তা ছড়িয়ে পড়ে বেলজিয়ামেও। বেলজিয়ামে গিয়ে অ্যান্টওয়ার্পে থাকতে শুরু করেন দীপক। সেখানেই জন্মান নীরব। সেই অ্যান্টওয়ার্প, যাকে বিশ্বে ‘হিরের রাজধানী’ বলা হয়।
আরও পড়ুন- নীরবের জন্য ব্যাঙ্কের নিজস্ব পাসওয়ার্ড পর্যন্ত চালান হয়ে গিয়েছিল
আরও পড়ুন- পিএনবি-কাণ্ডে শিকড় খুঁজতে হানা দেশ জুড়ে
গড়পড়তা ভারতীয়দের মতো ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার নীরব প্রথমে তাঁর বাবার রত্ন ব্যবসা দেখাশোনাও করতে চাননি। আমেরিকার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ার্টন স্কুলে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। কিন্তু সেটাও পুরোপুরি হল না। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তাই নীরব মোদী কলেজ ড্রপ-আউট।
কিন্তু ‘আউট’ হলেন না জীবনযুদ্ধে!
ভারতে ফিরে এলেন। তখন বয়স ১৯। বাবার রত্ন ব্যবসার অংশীদার ছিলেন মামা মেহুল চোকসি। বাবা দেখাশোনা করতে বলেছিলেন ব্যবসা। রাজি হননি। মামা বলতেই রাজি। সেই মামার সঙ্গেই তার পর দিন-রাত ব্যবসার দেখভাল করা। মামার কাছেই যাবতীয় কাজ শেখা। মামার সঙ্গেই যাবতীয় শলা পরামর্শ। মামা চোসকির অন্য পরিচয়ও ছিল। ভারতের অন্যতম বৃহৎ একটি হিরে সংস্থার প্রোমোটারও ছিলেন চোসকি। রত্নের পাইকারি ব্যবসায়ীদের তালিকায় নাম ছিল চোসকির। তাঁর সংস্থার নাম ছিল ‘গীতাঞ্জলি জেমস’। ২০১৩ সালে বাজারে ওই সংস্থার বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
মামার সঙ্গে কাজ করতে করতে তিনি যে নিজেই ‘রত্ন’ হয়ে উঠেছেন নীরবে-নিঃশব্দে, নীরব তা প্রথম বুঝতে পারেন ৩৭ বছর বয়সে। যখন তিনি তাঁর এক বন্ধুর জন্য চমকে দেওয়ার মতো নকশায় বানিয়ে দেন এক জোড়া কানের দুল। কানে কানে সেই বার্তা অনেক দূর রটে যায়। ছড়িয়ে পড়ে নীরবের খ্যাতি দ্রুত গতিতে।
২০০৪ সাল নীরবের জীবনে একটি মাইলস্টোন বছর। ওই বছরেই ‘ফায়ারস্টার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থার গোড়াপত্তন করেন নীরব। রত্ন ব্যবসায় নিত্যনতুন নকশা বাজারে আনায় ২০০৮ থেকেই নীরবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আলোর গতিতে, গোটা বিশ্বেই।
ভাগ্যের চাকা যে তড়তড়িয়ে গড়াতে শুরু করেছে, নীরব তা প্রথম বুঝতে পারেন ২০১০ সালের নভেম্বরে। যখন ক্রিস্টিজ’-এর অকশন ক্যাটালগের কভারে বড় করে ছাপা হয় নীরবের ছবি। সঙ্গে ছাপা হয় তাঁরই নকশায় বানানো ‘গোলকোন্ডা লোটাস নেকলেস’। গোলাপি রংয়ের ৯৯ ক্যারাটের সেই ‘পদ্ম’ নেকলেস হংকংয়ে ক্রিস্টিজ’-এর জুয়েলারি অকশনে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ৫৬ লক্ষ ডলারে।
‘পদ্ম’ বিছনো পথেই নীরবের ‘রিভিয়েরে অফ পারফেকশন’ হিরে ডলারের বন্যা বইয়ে দিল তাঁর পকেটে! হংকংয়ে সদবি’র জুয়েলারি অকশনে সেই হিরের দাম উঠল ৫ কোটি ১০ লক্ষ ডলার।
‘পদ্ম’-এর জয়জয়কার দিয়ে যার শুরু!
২০১৪-য় নীরব দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে খুললেন তাঁর ফ্ল্যাগশিপ স্টোর। তার পরের বছর মুম্বইয়ের কালা ঘোড়ায় খুললেন রত্নের আরও একটি ঝাঁ-চকচকে স্টোর। ওই বছরেই কয়েকটি ব্যুটিক খুললেন নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন অ্যাভিনিউয়ে। ২০১৬-য় ব্যুটিক খুললেন লন্ডনের ওল্ড বন্ড স্ট্রিটে। ২০১৭-য় ব্যুটিক খুললেন চিনে। লাস ভেগাস, হোনোলুলু, ম্যাকাও, হংকং ও সিঙ্গাপুর সহ গোটা বিশ্বে নীরবের হিরে ব্যবসা সংস্থার আউটলেটের সংখ্যা এখন ১৪।
পদ্ম’ দিয়ে যে জয়যাত্রার শুরু হয়েছিল, নতুন বছরের শুরুতেই তার ‘কাঁটা’র যন্ত্রণা এখন সইতে হচ্ছে রত্ন ব্যবসার ‘হীরকখণ্ড’ নীরবকে!
পলায়ন পরাজয়েরই ইঙ্গিতবাহী! পতনেরও যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy