Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
National News

শাপমুক্তির অপেক্ষায় শীর্ষ আদালতের দিকে তাকিয়ে দেশের মুসলিম মেয়েরা

২০১৬ সালের শুরুতে এ দেশের বেশ কয়েকটি সংগঠন তিন তালাক বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে। এর ফলে দেশের মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলির শরিয়তি আইন সংস্কারের আন্দোলন বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। কোর্টের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারও তিন তালাক বাতিলের পক্ষে সায় দেয়। এর পর ১৯৮৬-র সাহবানু মামলার স্মৃতি উসকে দিয়ে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন তিন তালাক বাতিলের বিরোধিতায় নেমে পড়ে।

মুসলিম মহিলারা নিজেরাই আন্দোলনে নেমেছেন তিন তালাক প্রথার অবসান চেয়ে। —ফাইল চিত্র।

মুসলিম মহিলারা নিজেরাই আন্দোলনে নেমেছেন তিন তালাক প্রথার অবসান চেয়ে। —ফাইল চিত্র।

রোশেনারা খান
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৭ ১৯:১৬
Share: Save:

২০১৬ সালের শুরুতে এ দেশের বেশ কয়েকটি সংগঠন তিন তালাক বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে। এর ফলে দেশের মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলির শরিয়তি আইন সংস্কারের আন্দোলন বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। কোর্টের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারও তিন তালাক বাতিলের পক্ষে সায় দেয়। এর পর ১৯৮৬-র সাহবানু মামলার স্মৃতি উসকে দিয়ে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন তিন তালাক বাতিলের বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তারা প্রচার করতে থাকে, কেন্দ্রীয় সরকার তিন তালাক বাতিলের মধ্য দিয়ে 'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি' চালু করে মুসলিমদের ধর্মীও অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। এবং এই ভয়েই অনেকে তিন তালাক বাতিলের বিপক্ষে।

তবে এ রাজ্যের যুক্তিবাদী এবং নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী 'প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ' এবং বেশ কয়েকটি সংগঠন যৌথ ভাবে তিন তালাকের বিরুদ্ধে নেমেছে। আলোচনা সভা ও অন্যান্য নানান কর্মসূচির মাধ্যমে তিন তালাক বাতিল ও মুসলিম মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জাতি-ধর্ম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ভাল সাড়াও তারা পাচ্ছে। এ ছাড়াও দীর্ঘ দিন ধরে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শামিল রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি ও আরও দু’একটি সংগঠন মৌখিক ও একতরফা তিন তালাক বাতিল ও কোর্টের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের দাবিতে ভিন্ন ভাবে আন্দোলন চালাচ্ছে।

মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড ও ধর্মীয় সংগঠনগুলিই যে শুধু তিন তালাক বাতিলের বিরোধিতা করছে তা কিন্তু নয়। এ রাজ্যে এত দিন যাদের অন্যান্য বিষয়ে প্রগতিশীল সমাজের পুরোধা হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে দেখা যেত, তিন তালাক বাতিলের প্রশ্নে তাঁরাও অনেকে এখন উল্টো সুরে কথা বলছেন। এই অংশের বক্তব্য, তালাকের সংখ্যা এমন কিছু বেশি নয়। এ সব সামান্য বিষয় নিয়ে আন্দোলন না করে মুসলিমদের শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আন্দোলন করা উচিত। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিন তালাক বাতিল নিয়ে আন্দোলন করলে অন্য সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করা যাবে না, তা তো নয়। তাহলে আপত্তি কেন? এক দল আবার কোরান হাদিসের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলছেন, আন্দোলনকারীরা ইসলাম ধর্মের শত্রু। ওরা নামেই মুসলিম।

কলকাতায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় সভায় এ রাজ্যের মুসলিম নেতা মন্ত্রীরাও তাঁদের বক্তব্যে যুক্তি দেখান, তালাক মানে মুক্তি। তালাকের পর মেয়েরা আবার বিয়ে করতে পারবেন। মুসলিম মহিলাদের কোর্টে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সরকার তিন তালাক বাতিলের বিপক্ষে।

অন্য দিকে আবার আন্দোলনকারী গোষ্ঠীগুলি তিন তালাক বাতিলের দাবিতে এক হলেও, এঁদেরও কেউ কেউ চান না সেই দাবি পূরণ বিজেপি সরকারের হাতে হোক ।

এই চাওয়া না চাওয়ার কারণটি স্পষ্ট হয় 'তালাক' কী এবং তার পদ্ধতিটি যদি স্পষ্টভাবে জানা থাকে। 'তালাক'-এর অর্থ বিবাহবিচ্ছেদ। কোরানে বলা হয়েছে তালাক খোদার কাছে সব চেয়ে অপ্রিয় শব্দ। তালাক উচ্চারিত হলে আসমানে খোদার 'আরস' (আসন) কেঁপে ওঠে। এ ক্ষেত্রে ধর্মকে উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী পুরুষেরা ফোন করে, মেসেজ বা চিঠি পাঠিয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে তিন তালাক দিয়ে নিমেষে নিজেকে মুক্ত করে নিচ্ছেন।

এ দেশের বেশির ভাগ মুসলিম সুন্নি। সুন্নিদের মধ্যে তিন তালাকের বিচ্ছেদের বিধান মেনে চলা হয়। শরিয়ত মতে তিন তালাকের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। অনেক কিছুর মত ধর্মও প্রাচীন হলে তার অবাঞ্ছিত শাখাপ্রশাখা গজায়। তখন তার সংস্কারের প্রয়োজন হয়।বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মলদ্বীপ, আফগানিস্থান, তুরস্ক, মিশর-সহ বিশ্বের বহু ইসলামিক রাষ্ট্রেই শরিয়তি আইনের সংস্কার করা হয়েছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক দলগুলির গা বাঁচানো, সুবিধাবাদী বা ভোটসর্বস্ব ভাবনা এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ডের অনমনীয় মনোভাবের জন্য। আইন সংস্কারের বিষয়ে ল' বোর্ড কোনও উদ্যোগই নেয়নি।

কয়েক দশক ধরে মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলি ল' বোর্ডের বার্ষিক সম্মেলনে শরিয়তি আইনের সংস্কার চেয়ে দাবিপত্র পেশ করে চলেছে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সংস্কারের ইঙ্গিত দিয়েও পরের অধিবেশনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া যাবে না।সংবিধান অবমাননার এর থেকে বড় উদাহরণ কী হতে পারে? শুধু তাই নয়, একতরফা মৌখিক তিন তালাক বাতিল প্রসঙ্গে আরও কঠোর ভাবে ল'বোর্ড জানিয়েছে, কোন দেশে কী হচ্ছে তা তারা জানতে চায় না। শরিয়তের বিধান না মেনেও কেউ তিন তালাক উচ্চারণ করলে তালাক হয়ে যাবে। একদম সম্প্রতি অবশ্য তিন তালাকের পক্ষে দাঁড়িয়েই ল’ বোর্ড বলছে, এই প্রথার অপব্যবহার হলে তারা তা মানবে না।

এক দিকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, অন্যদিকে ল’ বোর্ড, এই দু’পক্ষের ভূমিকার কারণেই সারা দেশ জুড়ে যুগ যুগ ধরে মুসলিম মহিলারা ভুল তালাকের শিকার হয়ে চলেছেন। এ রাজ্যের বীরভূম, দুই চব্বিশ পরগনা, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি মুসলিমবহুল জেলাগুলির গ্রামাঞ্চলে গেলে তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ও তাঁদের সন্তানদের নিদারুণ জীবনযাত্রার ছবি চোখে পড়বে। শোনা যাবে 'হালালা' বিয়ের জঘন্য কাহিনি। হালালা বিয়ের অর্থ- স্বামী রাগের বশে বা নেশার ঘোরে তিন তালাক দিয়ে পরে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে, সেই মহিলাকে প্রথমে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে শুধু রাত্রিবাস নয়, শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর সালিশির রায় মেনে দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিলে, তবেই প্রথম স্বামী তাকে পুনরায় বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারবে। শরিয়তে কিন্তু এ ভাবে বিয়ের কথা বলা হয় নি। সম্পূর্ণ বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে ঘটতে হবে। মহিলাটি যদি কোনও কারণে দ্বিতীয় স্বামীর দ্বারাও তালাকপ্রাপ্ত হন বা বিধবা হন, তখন দু’জনে রাজি থাকলে তবেই প্রথম স্বামীর সঙ্গে পুনরায় বিয়ে করতে পারে। বিয়ে সামাজিক রীতি নিয়মের মধ্যে পড়লেও বিবাহবিচ্ছেদ কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই বিচার্য বিষয়। তাই মধ্যযুগীয় প্রথায় নয়, আদালতেই বিচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়া উচিত। এ দেশের মুসলিম মহিলাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। শোষণ, পীড়ন, বঞ্চনার শিকার হতে হতে আজ তারা রুখে দাঁড়িয়েছেন। মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড মুসলিম মহিলাদের সুরক্ষা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাই তাঁরা কোর্টের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়েছেন।

আশ্চর্যের বিষয়, যাঁরা তিন তালাকের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা কেউ বিচ্ছেদ হওয়া বাবা মায়ের শিশু সন্তানদের কথাও ভাবছেন না! অতিরিক্ত যৌতুকের কারণে কুমারী মেয়েদেরই বিয়ে হওয়া মুশকিল, তবুও যদি ধরে নেওয়া যায় মহিলার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে সন্তানদের কী হবে? তারা কেন আপন বাবা মায়ের স্নেহ ভালবাসা, নিজের প্রাপ্য অধিকার এবং বেড়ে ওঠার সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হবে? সমাজকর্মীরা মনে করছেন, এই তালাকই অনেক শিশুকে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পথ করে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন: ফর্সা ত্বকে আকৃষ্ট সমাজকে সপাটে চড় কষালো এই তিন সুন্দরীর ছবি

ভুল পদ্ধতিতে দেওয়া তিন তালাক বাতিল হলে যে ধর্মে আঘাত লাগবে না, মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড তা জানে। তবে কি এই বিরোধিতা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে? এদের সম্বন্ধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ ওসমান গনী বহু দিন আগেই লিখেছেন, 'মুসলিম সমাজের বহু নামকরা বড় বড় জামাতগোষ্ঠী কোরানের বিশুদ্ধ তালাককে লাটে তুলে মন গড়া তিন তালাকের ফতোয়া জারি করে সমাজের সর্বনাশ তো করছেনই, অধিকন্তু কোরানের বিধানটিকেও বধ করছেন। কোরানের তালাক বিধিকে অধিকাংশ মোল্লাই 'তালাক' দিয়েছেন।'

মোদী ও এনডিএ সরকারকে এ দেশের আপামর মুসলিম সমাজ যে দৃষ্টিতেই দেখুন না কেন, মোদীর 'চেয়ার' আর সরকারের 'পাওয়ার'কে তো অস্বীকার করা যায় না। 'কবে রাম রাজা হবে তবে দেশে শান্তি আসবে' সেই অপেক্ষায় না থেকে লোহা গরম থাকতেই হাতুড়ির ঘা দিতে হবে। সেই কাজটি করার জন্য এ রাজ্যের প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ সমস্ত বাধা, কটাক্ষ, বিদ্রূপ উপেক্ষা করে তিন তালাক রদ ও মুসলিম মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পাশে দাঁড়িয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান, আইনজীবী, সমাজকর্মী-সহ বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। ১১ মে সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাক বাতিলের মামলার শুনানি শুরু হবে। এ দেশের মুসলিম মহিলাদের শাপমুক্তি কবে ঘটবে তা নির্ভর করছে কোর্টের এই রায়ের উপর।

(লেখক সমাজ কর্মী)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE