সুজনে বলছেন, এ যুগের রামায়ণ-মহাভারত। কখনও রামায়ণের মতো— কৈকেয়ী-মন্থরার গল্প। কখনও মহাভারতের মতো— পরিবারের মধ্যেই যুদ্ধ।
দুর্জনের আবার অন্য রা। তাঁরা বলছেন, ধুস! এটা আসলে চল্লিশ চোরের কাহিনি। সবাই ডাকাত! লুঠের ভাগ নিয়ে মারামারি।
রামায়ণ-মহাভারত যা-ই হোক, একটা কথা সকলেই বলছেন। উত্তরপ্রদেশের এই যাদব পরিবারটি গত পাঁচ বছরে লখনউয়ের তখতে থাকার সুবাদে ফুলেফেঁপে এমন বহরে পৌঁছেছে যে, এত দিন গোল বাধেনি কেন, সেটাই আশ্চর্যের। মুলায়ম সিংহ যাদবের পরিবারের আকার এত বড় যে, কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, তা বুঝতে যাওয়া মানে লখনউয়ের ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পড়া! আর সেই পরিবারের সকলেই কেউকেটা! এ সাংসদ, ও মন্ত্রী, সে বিধায়ক, তিনি সরকারি নিগমের চেয়ারম্যান, নিদেনপক্ষে জেলা পঞ্চায়েত বা ব্লক উন্নয়ন পরিষদের প্রধান তো বটেই! যার দৌলতে সকলেই বিলক্ষণ ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কেউ অর্থে, কেউ ক্ষমতায়। এখন সকলের গলাতেই ‘মোরে আরও আরও আরও দাও...’ সুর!
কিন্তু অর্থের থেকেও তো ক্ষমতার মধু বেশি। লখনউয়ের গুঞ্জন, সেই ক্ষমতার ভাগ নিয়েই গোল বেধেছে যাদব বংশের অন্দরমহলে। ‘দশরথ’ মুলায়মের দুই স্ত্রী— ‘কৌশল্যা’ মালতী ও ‘কৈকেয়ী’ সাধনার ছেলেদের মধ্যে। মুলায়মের প্রথম স্ত্রী মালতী দেবী প্রয়াত। তাঁর ছেলে অখিলেশ এখন মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা গুপ্তর ছেলে প্রতীক এত দিন ব্যবসা আর শরীরচর্চা নিয়েই ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অপর্ণা চাইছেন অখিলেশের স্ত্রী তথা কনৌজের সাংসদ ডিম্পলের মতো রাজনীতিতে নামতে। আগামী বছর বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হতে চান তিনি। সাধনা চাইছেন, বৌমা তো বটেই, ছেলে প্রতীকই বা কেন রাজ্যপাটে বঞ্চিত থাকবে? আসরে নেমে মেয়ে-জামাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন প্রতীকের শাশুড়ি অম্বি বিস্ত। সব মিলিয়ে এক ভজকট দশা! সপা-শিবিরে গুঞ্জন, মুলায়ম এক সময় নাকি সাধনাকে কথা দিয়েছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার দুই ছেলেকে সমান ভাগে ভাগ করে দেবেন। কিন্তু ‘নেতাজি’ কথা রাখেননি!
অখিলেশ শিবিরের অভিযোগ, ‘মন্থরা’ অমর সিংহ দলে ফিরেই সাধনা-অম্বি-অপর্ণাদের উসকে দেওয়ার কাজটি মন দিয়ে করেছেন! এঁদের মন্ত্রণাতেই অখিলেশের ক্ষমতা ছাঁটতে তাঁকে প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে ভাই শিবপালকে বসিয়েছেন মুলায়ম। পাল্টা চালে শিবপাল ও সৎ মায়ের ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী গায়ত্রীপ্রসাদ প্রজাপতিকে মন্ত্রিসভা থেকে ছেঁটে ফেলেছেন অখিলেশ।
ক্ষমতার মধু নিয়ে ঝগড়ার পাশাপাশি অর্থের চিনি নিয়েও কি বিবাদ কম? বিক্রমাদিত্য মার্গে সপা-দফতরের সিন্দুকের চাবি নিয়েও নাকি জোর ঝামেলা! উত্তরপ্রদেশ দখলে মরিয়া বিজেপি নেতারা বলছেন, গোলমালের আসল কারণ সেটাই। বিজেপি নেতা জিভিএল নরসিংহ রাও বলেন, গোটা সপা-পরিবার এত দিন দুর্নীতির যে অর্থ জমা করেছে, তার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়েই ঝগড়া লেগেছে।লোহিয়াপন্থীদের দলের জন্য শিল্পপতিদের থেকে চাঁদা আদায়ের কাজটা শুরু করেছিলেন অমর সিংহ। তখন বাপ-ছেলে-কাকায় ভাব থাকায় কোনও সমস্যা হয়নি। এখন অমর দলে ফিরে সভাপতি শিবপালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই চাবি বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভোটের সময় টাকা খরচ, টিকিট বণ্টনের কাজটাও তাঁরা নিজেদের হাতেই রাখতে চান। আর তাতেই আপত্তি অখিলেশের। উত্তরপ্রদেশে একটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির বরাত নিজের ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীকে অমর দিতে চাইছেন বলেও অভিযোগ। তাতেও আপত্তি অখিলেশের। হজরতগঞ্জের রেস্তোরাঁ মালিক মহম্মদ আতিক বলছিলেন, ‘‘মাস দেড়েক আগেও সোনার সংসার ছিল। ‘গুন্ডা’ চাচার দুর্নীতি ঠেকাতে গিয়েই ঝামেলায় পড়েছেন অখিলেশ। মাঝখান থেকে গোটা পার্টিটাই বরবাদ হয়ে গেল!’’ দুর্নীতির আরও কাদা ঘুলিয়ে উঠছে এই বাজারে। মুলায়মের বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির সিবিআই মামলা ছিলই। মুলায়মের ভাই শিবপাল এখন অভিযোগ করছেন, তাঁদের খুড়তুতো ভাই রামগোপালের ছেলে অক্ষয় যাদবও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই মামলা আটকাতেই বিজেপির শরণাপন্ন হয়েছেন রামগোপাল। অক্ষয় যাদব দু’বছর আগে ফিরোজাবাদ থেকে জিতে প্রথম বার লোকসভায় সাংসদ হয়েছেন। সিবিআই তদন্তে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থার সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক যোগাযোগ মিলেছে। সপা-র এক প্রবীণ নেতা এমন অসামান্য কোন্দলকে তাত্ত্বিক মোড়ক দিচ্ছেন! তাঁর যুক্তি, মুলায়ম এত দিন জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট লড়েছেন। অখিলেশ তরুণ প্রজন্মের মন জিততে উন্নয়নকে হাতিয়ার করে ভোটে যেতে চান। প্রবীণ নেতারা সেটাই মানতে পারছেন না। সেটা নিয়েই নাকি দুই প্রজন্মের বিবাদ।
সপা কর্মীদের আশঙ্কা, ভোটের বাজারে এ সব যুক্তি কেউ শুনবে না। নেতাদের কাদা ছোড়াছুড়িকেই অস্ত্র করবে বিজেপি-বসপা। তাতে শুধু লখনউ নয়, গোটা উত্তরপ্রদেশেই সঙ্কটে পড়বে যাদব বংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy