Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শত্রুর গোলা নয়, ভয়ঙ্কর প্রকৃতিই মৃত্যু নিয়ে অপেক্ষায় থাকে সিয়াচেনে

ভয়াবহ তুষারধসে ১০ সেনা জওয়ান চাপা পড়ার পর হঠাৎ আলোচনায় সিয়াচেন। কিন্তু সিয়াচেনে এমন ঘটনা নতুন নয় মোটেই। গত তিন দশকে পৃথিবীর ওই সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র প্রাণ নিয়েছে শ’য়ে শ’য়ে সেনাকর্মীর। গুলি-বোমা-মর্টারের আঘাত নয়।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৪:০৯
Share: Save:

ভয়াবহ তুষারধসে ১০ সেনা জওয়ান চাপা পড়ার পর হঠাৎ আলোচনায় সিয়াচেন। কিন্তু সিয়াচেনে এমন ঘটনা নতুন নয় মোটেই। গত তিন দশকে পৃথিবীর ওই সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র প্রাণ নিয়েছে শ’য়ে শ’য়ে সেনাকর্মীর। গুলি-বোমা-মর্টারের আঘাত নয়। দুর্গম, দুর্জয় হিমবাহের খামখেয়ালি প্রকৃতির মারই অভিশাপ হয়ে দেখা দেয় সেখানে কর্তব্যরত সেনাকর্মীদের সামনে। প্রায় প্রত্যেক পদক্ষেপে অপেক্ষা করে থাকা বিপদ এড়িয়ে বেঁচে থাকাই জীবন সেখানে।

হিমালয় আর কারাকোরামের শেষ প্রান্তদু’টির মাঝে ৭২ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিয়াচেনে বিপদ কত রকমের?

তুষারধসে কী হতে পারে, সিয়াচেনে ৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনা তা আবার দেখিয়ে দিয়েছে। প্রবল ঠান্ডায় প্রতি মুহূর্তে বরফের পরত জমতে জমতে হিমবাহ রোজ আকার বদলাতে থাকে। এক এক অংশে এক এক রকম আকৃতি নিতে থাকে বরফের স্তূপ। নিজের খেয়ালেই সেই স্তূপ ভেঙে পড়ে। বিধ্বংসী স্রোতের মতো ঢাল বেয়ে নীচে নামতে থাকে সেই বরফ। তার গতিপথে যা কিছু আসে, সবই নিমেষে হারিয়ে যায় বরফের সাম্রাজ্যের নীচে। ৭২ কিলোমিটার লম্বা হিমবাহের সর্বত্রই এই ভাঙাগড়া চলতে থাকে নিরন্তর। টহলদারির সময় চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আসন্ন বিপদের গন্ধ খুঁজে নিতে হয় কর্তব্যরত জওয়ানদের। খাড়াই পাহাড়ে বরফের দেওয়ালে ফাটল ধরল কি? পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কি গড়িয়ে এল বরফের গুঁড়ো? হিমবাহে কর্তব্যরত সেনাকর্মীদের সব সময় খেয়াল রাখতে হয় এই সব বিষয়। কারণ বরফের ঢালে ফাটল বা ঢাল বেয়ে হঠাৎ গড়িয়ে আসা বরফের গুঁড়ো আসন্ন তুষারধসের ইঙ্গিত দেয়।

তুষারধসের চেয়েও মারত্মক হল ব্লিজার্ড বা তুষারঝড়। বরফের প্রচণ্ড ঝড় যখন শুরু হয়, তখন কমপক্ষে এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে বাতাসে ভেসে আসা বরফের তাণ্ডব। বরফের পুরু আস্তরণে ঢেকে যায় গোটা হিমবাহ। কখনও কখনও এই তুষারঝড় ১৫-২০ দিন ধরে চলতে থাকে। আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে যায় যে হেলিকপ্টার নিয়ে সেই সময় সিয়াচেন থেকে কাউকে উদ্ধার করে আনাও সম্ভব হয় না। এই ভয়ঙ্কর তুষারঝড়ের সামনে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করার ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

ক্রিভাস হল সিয়াচেনের বিপদের আর এক মারাত্মক বিপদ। হিমবাহের খাড়াই দেওয়ালগুলির মাঝে যেখানে গভীর খাদ বা উপত্যকার মতো অংশ থাকে, সেখানে জমে থাকা বরফের আস্তরণ অনেক সময় আড়াআড়ি ফেটে যায়। এই ফাটলকে ক্রিভাস বলে। বরফের উপর দিয়ে হেঁটে চলার সময়ে লক্ষ্য রাখতে হয় ফাটল তৈরি হয়েছে কি না। ক্রিভাস প্রথম পর্যায়ে খুব সুক্ষ্ম ফাটলের মতো তৈরি হয়। চোখে পড়ে না। হঠাৎ ফাটলের হাঁ-মুখ চওড়া হতে শুরু করে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পাহাড়ের খাঁজে জমে থাকা বরফ বসে যেতে শুরু করে নীচের দিকে। এই বিপর্যয়ের মুখে পড়লে হিমবাহের গভীরে সর্বস্ব নিয়ে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। তাই সিয়াচেনে কর্তব্যরত জওয়াদের প্রতিটা পা ফেলার আগে দেখে নিতে হয়, কোথাও ফাটল তৈরি হয়নি তো?

১৮ থেকে ২০ হাজার ফুট উচ্চতা সিয়াচেনের বিভিন্ন অংশে। এত উঁচুতে অক্সিজেন সরবরাহ কম। কৃত্রিমভাবে অক্সিজেনের সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতেই হয়। কিন্তু তাতেই সব সমস্যা মিটে যায় না। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বহু নীচে থাকায় ফুসফুসে ফ্লুইড জমে যায়। তাতে দম বন্ধ হয়ে আসে। কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

একই সমস্যার মুখে পড়ে মস্তিষ্কও। অনেক সময় মস্তিষ্কে অর্থাৎ ব্রেনে ফ্লুইড জমাট বেঁধে যায়। তেমন হলে মৃত্যু অবধারিত।

দেখুন গ্যালারি:

একেই বলে 'বিস্ময়কর পৃথিবী'!

ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা রয়েছে সিয়াচেনে কর্তব্যরত সেনাকর্মীদের জন্য। কিন্তু অনেক সময়ই তাতেও কাজ হয় না। গ্লাভস ছাড়া খালি হাতে রাইফেল ধরলে হাতের তালুর চামড়া ছিঁড়ে আসে। লেগে যায় রাইফেলের গায়ে। চোখ থেকে সানগ্লাস খোলার উপায় নেই। তা হলেই চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সাদা বরফের উপর থেকে ঠিকরে আসা সূর্যালোক চোখ এমন ধাঁধিয়ে দেয় যে বেশ কয়েক দিনের জন্য অন্ধ হয়ে পড়ে থাকতে হয় তাঁবুতে। একে স্নো-ব্লাইন্ডনেস বলে। খালি চোখে দীর্ঘক্ষণ এই ঠিকরে আসা সূর্যরশ্মি সইতে হলে চিরতরে নিভে যেতে পারে চোখের আলো।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে সিয়াচেনে টহল দিচ্ছে ভারতীয় সেনা। বিপদ আর মুখিয়ে থাকা মৃত্যুর সঙ্গে এক সংসারে বাস। সিয়াচেনের সেনা ছাউনিগুলিতে জীবনকে সহজ করে তোলার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ব্যবস্থাপনা আগের চেয়ে এখন উন্নত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অনেক চাহিদাই এখনও অপূর্ণ। জর্জ ফার্নান্ডেজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সিয়াচেন সফরে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম ভারতের কোনও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সিয়াচেন যান। দেখেছিলেন আইস-স্কুটার অকেজো হয়ে রয়েছে। মেরামতির জন্য দিল্লিকে বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ব্যবস্থা হয়নি। কেরোসিনের বড় বড় ব্যারেল মাথায় করে বয়ে নিয়ে বরফ কেটে এগোচ্ছেন জওয়ানরা। দিল্লি ফিরে মন্ত্রকের আমলাদের তীব্র তিরস্কার করেন জর্জ। তার পর থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে সিয়াচেনের ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু এখনও অনেক কিছু বাকি।

রাইফেল নিয়ে জওয়ানরা টহল দেন সিয়াচেনে। কিন্তু একটা গুলি খরচ করার আগে প্রস্তুত হয়ে নিতে হয় নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনার জন্য। কারণ আদিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু ফাঁকা বরফের প্রান্তরে গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ হিমবাহের দেওয়ালে ফাটল ধরিয়ে দেয়। যা ডেকে আনতে পারে সেই চেনা তুষারধস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE