Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঢের হল সাদাকালো, পোশাকে রেল-বিপ্লব

সাহেবি আমলের ‘হ্যাট’ এখন কালেভদ্রে পরেন স্টেশনমাস্টার মশাইরা। গার্ড সাহেবদের সাদা পোশাকের বুকে রাজকীয় ‘ক্রসবেল্ট’ও কদাচিৎ দেখা যায়। মন্ত্রীমশাই বা কর্তারা পরিদর্শনে না-এলে এ সব ধরাচুড়ো চাপানোর বিধি কার্যত উঠেই গিয়েছে রেলে।

নতুন পোশাকের চার থিম। ভোট দেবে জনতা। ছবি রেলের সৌজন্যে।

নতুন পোশাকের চার থিম। ভোট দেবে জনতা। ছবি রেলের সৌজন্যে।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৩
Share: Save:

সাহেবি আমলের ‘হ্যাট’ এখন কালেভদ্রে পরেন স্টেশনমাস্টার মশাইরা। গার্ড সাহেবদের সাদা পোশাকের বুকে রাজকীয় ‘ক্রসবেল্ট’ও কদাচিৎ দেখা যায়। মন্ত্রীমশাই বা কর্তারা পরিদর্শনে না-এলে এ সব ধরাচুড়ো চাপানোর বিধি কার্যত উঠেই গিয়েছে রেলে।

‘টিটিবাবু’র কালো কোট অবশ্য অমলিন। টুপি-বেল্ট বাদ দিলেও স্টেশনমাস্টার বা গার্ডসাহেবদের পোশাক আজও কিন্তু দুধসাদা। ট্রেনচালকদের আকাশি আর গাঢ় নীল শার্ট-প্যান্ট। লাইনের দেখভাল করা গ্যাংম্যানদের হালে দেখা যায় উজ্জ্বল কমলা পোশাকে। আর পয়েন্টসম্যানেরা এখনও আছেন খাকি-তে।

রেলযাত্রীর চোখে লেগে থাকা এই রংগুলোই এ বার বদলে যেতে চলেছে। চালক, গার্ড, টিকিট পরিদর্শক, স্টেশনমাস্টার, গার্ড থেকে গ্যাংম্যান-পয়েন্টসম্যান— সকলেরই সাবেক উর্দি পাল্টে ফেলে যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। দিল্লির রেল ভবনের এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘সাহেবি আমলের হ্যাট-কোটে রেলের অফিসারেরা গরমে গলদঘর্ম হন। পোশাক রুচিসম্মত রেখে একটু স্বাচ্ছন্দ্য এলে ক্ষতি কী?’’

এই ‘পরিবর্তনে’র ভার দেওয়া হয়েছে ফ্যাশন ডিজাইনার ঋতু বেরিকে। তাঁর ঠিক করা চার রকম পোশাকের ‘থিম’ রেলের ওয়েবসাইট থেকে ফেসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্ট— সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটা জনতাকেই দিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। চালু হয়েছে ভোটাভুটি। এই ভোটের ভিত্তিতেই ঠিক হবে, কোন নকশার উর্দি ধার্য হতে চলেছে রেলকর্মীদের জন্য।

কর্তারা জানাচ্ছেন, রেলের যে কর্মীদের সঙ্গে সাধারণ যাত্রীদের নিত্য মোলাকাত হয়, নতুন পোশাকের ভাবনাটা মূলত তাঁদের ঘিরেই। আপাতত ঠিক হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে রেলের ১৩ লক্ষ কর্মীর মধ্যে পাঁচ লক্ষ নয়া ইউনিফর্ম পাবেন। এর জন্য খরচ হবে ৫০ কোটি টাকা। চালক-গার্ডদের পাশাপাশি এই প্রকল্পের আওতায় রাখা হয়েছে কেটারিং কর্মী ও স্টেশনের কর্মীদেরও।

কেমন হবে নতুন পোশাক?

দেখা যাচ্ছে, ঋতুর ডিজাইনে সেকেলে সাদা-কালো-খাকির গোমড়াভাব ঝেড়ে ফেলে এসেছে রঙের বন্যা। ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের ছোঁয়া তাতে টুকরো টুকরো মোটিফে ধরা হয়েছে। চার রকমের থিমের একটির মূল সুর ভারতীয় আদিবাসী লোকশিল্প থেকে চারুকলা। মধুবনী থেকে মেহেন্দি। আর একটি থিমে ভারতের ইতিহাস ও প্রাচীন স্থাপত্যের রং। নালন্দা, হরপ্পা, সাঁচির চির-চেনা ছবিগুলোর সঙ্গে প্রাচীন মুদ্রার কোলাজ। একটিতে আবার নবাবি পরম্পরা। সূক্ষ্ম জাফরির উজ্জ্বল নকশার প্রাধান্য সেখানে। চতুর্থটিতে সমকালীন ভারতীয় পপ আর্টের ছোঁয়া। কথাকলি থেকে অটোরিকশা একাকার। রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, একেলে ইন্দো-ওয়েস্টার্নকাটের পোশাকে ভারতীয় মেজাজটাই ধরা পড়বে। ছেলেদের জন্য টি-শার্ট গোছের পোশাক, মেয়েদের শাড়ি থাকারই সম্ভাবনা।

হঠাৎ এই ভোল বদল কি খানিক ধাক্কা দেবে না এত দিনের অভ্যস্ত চোখে? ‘‘দিলেই তো ভাল!’’— হেসে বলছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘চেকারের রং সক্কলের জেনে ফেলাটা কি সব সময়ে ভাল? টিকিট ফাঁকি দেওয়া দুষ্টু ছেলেরা কালো কোট দেখে সাবধান না-হয়ে গেলেই তো রেলের লাভ!’’ বিপণন বিশেষজ্ঞ রাম রায়ও স্বাগত জানাচ্ছেন পরিবর্তনকে। বলছেন, ‘‘এটাই স্বাভাবিক! আমরা তো আর নম্বর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফোন ডায়াল করি না।’’ রামের বক্তব্য, অভিজাত ক্লাবে-টাবে উপনিবেশ আমলের কিছু ট্র্যাডিশনের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা থাকে ঠিকই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যকে গুরুত্ব দিয়ে ঠিকই করেছেন রেল কর্তৃপক্ষ।

‘স্বাচ্ছন্দ্য’ বা ‘যুগোপযোগী হওয়া’র আড়ালে অবশ্য আরও একটি উদ্দেশ্যও লুকিয়ে রয়েছে। নামী কিছু সংস্থাকে দিয়ে নতুন পোশাকের ‘ব্র্যান্ডিং’ করানোর কথা ভাবছে রেল ভবন। তাতে পোশাকের খরচ পুষিয়ে রেলের সিন্দুকে মোটা টাকা আসার সম্ভাবনাও দেখছেন কর্তারা। এমনিতেই টিকিটে বছরে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে গিয়ে রেলের জেরবার দশা। নতুন পোশাকের ছোঁয়ায় সেই সঙ্কট খানিক ফিকে হলে মন্দ কী!

এই রঙিন স্বপ্নটুকুও তাই এখন সম্বল রেলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Rail Uniform Revolution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE