Advertisement
E-Paper

বাজনা আর বাস্তবের ফারাকটাই কাঁটা হল বিজেপির

দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে যে কংগ্রেসের সংগঠন এবং আত্মবিশ্বাস প্রায় তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল গুজরাতে, সেই কংগ্রেস এ বার কী ভাবে এতখানি লড়াইয়ের মধ্যে ফিরে এল?

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৪২
পানীয় জল নেই। খোলা পুকুর থেকেই জল আনতে হয় এই গ্রামে।

পানীয় জল নেই। খোলা পুকুর থেকেই জল আনতে হয় এই গ্রামে।

একের পর এক বুথফেরত সমীক্ষা গুজরাতে বিজেপির বড়সড় জয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উতরে গেলেও, গণনার মাঝপথে রীতিমতো ভয় ধরেছিল গেরুয়া শিবিরে। একটা সময় এগিয়ে পর্যন্ত ছিল কংগ্রেস।

গণনা শুরুর আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলির অফিসে, অমদাবাদের চায়ের দোকানে, গুজরাতের আনাচে-কানাচে জোর আলোচনা সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে। সে আলোচনার এক প্রান্তে রয়েছে জিএসটি এবং নোটবন্দির বিরুদ্ধে শহুরে এবং আধা-শহুরে জনতার ক্ষোভ, কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দীর্ঘ অবহেলা, গ্রামীণ এলাকায় পানীয় জলের অভাব, জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক কম হারে মজুরি, পাটিদার বিক্ষোভ, দলিত উষ্মা। আর ২২ বছরের সরকারটার বিরুদ্ধে ক্ষোভের এই গুচ্ছ কারণের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একা নরেন্দ্র মোদী।

গত দু’দশকে এত তপ্ত নির্বাচনী লড়াই গুজরাত দেখেনি। কিন্তু এ বারের নির্বাচনে কংগ্রেস কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাল বিজেপিকে। দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে যে কংগ্রেসের সংগঠন এবং আত্মবিশ্বাস প্রায় তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল গুজরাতে, সেই কংগ্রেস এ বার কী ভাবে এতখানি লড়াইয়ের মধ্যে ফিরে এল?

আরও পড়ুন: ‘হিন্দু মানে ত্রাস নয়, বিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিয়েছিল কলকাতা’

ফিরে এল অনেকগুলো কারণে। হার্দিক পটেল, অল্পেশ ঠাকোর এবং জিগ্নেশ মেবাণীর মতো তিন নেতাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে রাহুল গাঁধীর বড় সাফল্য। তার সঙ্গে যোগ হল ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ ফ্যাক্টর। উন্নয়নের ‘গুজরাত মডেল’-এর কথা গোটা ভারতে ফলাও করে প্রচার করেছেন নরেন্দ্র মোদীরা। কিন্তু সেই মডেলের সাফল্য নিয়ে গুজরাতের বুকেই সংশয় বিস্তর। কয়েকটি অর্থনৈতিক সূচকে গুজরাতের অবস্থান উপরের দিকে, এ কথা ঠিক। কিন্তু সামাজিক সূচকে বা মানবোন্নয়ন সূচকে প্রায় কোনও উন্নতি হয়নি এই ২২ বছরে।

গুজরাত কোথায় দাঁড়িয়ে (দেশের বড় ২০টি রাজ্যের মধ্যে)

আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিতে গুজরাত

তথ্যসূত্রঃ আরবিআই প্রকাশিত সাম্প্রতিক স্টেট‌‌‌স হ্যান্ডবুক

* এই র‌্যাঙ্কিং ২০১১ সালের। ১৯৯৩ সালে গুজরাত ছিল ৩ নম্বরে। (তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন, ভারত সরকার)

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অত্যন্ত কম গুজরাতে। সরকারি আয়ের মাত্র ২ শতাংশ খরচ করা হয় শিক্ষার জন্য (জাতীয় গড় ৫-৬ শতাংশ)। বি‌শুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই এখনও অনেক গ্রামেই। একটু গুরুতর অসুখ করলেই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা মেলে না। বিপুল খরচসাপেক্ষ বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ভরসায় থাকতে হয়। সরকারি আয়ের মাত্র ০.৮ শতাংশ যেখানে স্বাস্থ্য খাতে খরচ হয় (জাতীয় গড় ৪-৬ শতাংশ), সেখানে অবশ্য এটাই খুব স্বাভাবিক চিত্র। বিভিন্ন শিল্প-তালুক গড়ে কল-কারখানা কিছু হয়েছে বটে। কিন্তু সে সব শ্রমনিবিড় শিল্প নয়। ফলে কর্মসংস্থানও তেমন হয়নি। গ্রামে-গঞ্জে ক্ষেতমজুরি করে দিন গুজরান করেন যাঁরা, তাঁরা মাসে বড়জোর ১৫ দিন কাজ পান। কোথাও মজুরি দিনে ২২৫ টাকা, কোথাও ২০০, কোথাও আবার ১০০ টাকাও। বলা বাহুল্য, মজুরির এই সবক’টি হারই জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক কম।

দেখুন ভিডিও: গুজরাতের গ্রামে সরেজমিনে

ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের বিপুল ঢক্কানিনাদের তলায় এই ক্ষোভগুলো চাপা ছিল দীর্ঘ দিন। হার্দিকদের তীব্র আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে, গুজরাতে সরকারের বিরুদ্ধেও মুখ খোলা যায়। ফলে গ্রামে-গঞ্জেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বেশ ভালই এ বার।

সব রকমের ক্ষোভকে একত্র করেই দ্রুত লড়াইয়ে উঠে আসছিল কংগ্রেস। কয়েক মাস আগে হওয়া বেশ কিছু সমীক্ষা ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিল, বিজেপি-কংগ্রেস কাঁটায় কাঁটায় টক্কর এ বার। বিজেপি-র জনপ্রিয়তার সূচক কমে আসার ইঙ্গিত মিলছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই মাঠে নামলেন নরেন্দ্র মোদী নিজে। কংগ্রেসের পালের হাওয়া কেড়ে নিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন। রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে বিজেপি-কে ক্ষমতায় রাখা দরকার কেন সে ব্যাখ্যা তো দিলেনই, গোটা রাজ্যে একের পর এক সভা করে কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ করতে থাকলেন, গুজরাতি অস্মিতার কথা বললেন, তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ তুললেন, মণিশঙ্কর আইয়ার-সলমন নিজামিদের নানা মন্তব্য তুলে ধরে দাবি করলেন, তাঁকে তথা গুজরাতকে অপমান করছে কংগ্রেস। নরেন্দ্র মোদীর এই চড়া সুর গুজরাতের ভোট আবহে প্রভাব ফেলেছে। ভোটের হাওয়া কি‌ছুটা হলেও ঘোরাতে সক্ষম হয়েছেন মোদী। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজীব শাহ বলছিলেন, ‘‘মোদী এসে হাওয়াটা অনেকটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তার আগে পর্যন্ত কংগ্রেস কিন্তু অ্যাডভান্টেজে ছিল।’’ গুজরাতের সাধারণ মানুষও যে এই রকমই ভাবছেন, তার প্রমাণ মিলল বীরমগামে গিয়ে। হার্দিক পটেলের একনিষ্ঠ অনুগামী হর্ষ পটেল বললেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী প্রচারে না এলে এ বার কোনও লড়াই-ই হত না। এখনও বলছি কংগ্রেসই এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু মোদী যদি এত সভা না করতেন, শওটাকা (১০০ শতাংশ) বলে দিচ্ছি, বিজেপি হারতই।’’

গুজরাত: আরও কিছু তথ্য

• দেশে সবচেয়ে কম মজুরির হার যে রাজ্যগুলিতে, গুজরাত তাদের অন্যতম। গত এক দশকে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

২১০ টাকা

কী কারণে নিজের দুর্গে এত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হল মোদীকে? ভোটের ফল শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, মাটির বাস্তবতাটা কি বদলে গিয়েছে? শহুরে উন্নয়নের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামে পা রাখলে কি ‘গুজরাত মডেল’-এর ছবিটা একই রকম থাকছে?

অমদাবাদ থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম সাকেরিয়া। উঠোনে খাটিয়া পেতে রোদ পোহাচ্ছিলেন কামুভাই। বললেন, ‘‘কয়েক মাস আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সরকারি হাসপাতালে গেলাম। বলল এখানে চিকিৎসা হবে না, অমদাবাদে যাও। সেখানে গেলাম। সরকারি হাসপাতাল সেখানেও কিছু করল না। চার লক্ষ টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসাপাতাল থেকে চিকিৎসা করাতে হয়েছে।’’

আরও পড়ুন: গুজরাতে ভাল ফল হবে না, বিজেপি সাংসদের মন্তব্য ঘিরে জল্পনা

বউ-ছেলে-মেয়ে মিলে সাত-আট জনের সংসার কামুভাইয়ের। বাড়ি বলতে একটা চালাঘর, উঠোন সমান মেঝে। দিনমজুরি করে সংসার চালান। মাসের অর্ধেক দিন কাজ পান, অর্ধেকটা বসে থাকেন। মেরেকেটে ১৫০০ টাকা আয়।

চার লক্ষ টাকা পেলেন কোথায়? ‘‘সুদে ধার নিয়েছি। চড়া সুদ দিতে হচ্ছে।’’ বললেন কামু ভাই।

আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা মিলল পোপটজিভাইয়ের। তিনি বললেন, ‘‘দেখছেনই তো গ্রামের অবস্থা। পানীয় জলের কোনও বন্দোবস্ত নেই। গ্রামের বাইরে অনেকটা দূরে পুকুর রয়েছে। রোজ মহিলারা সেখান থেকে খাবার জল নিয়ে আসেন। স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে প্রায় কিছুই নেই। প্রত্যেক বাড়িতে শৌচালয় দেখছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু সে সব ব্যবহার করা যায় না। মাত্র দু’তিন হাত মাটি খুঁড়ে, তার উপরে শৌচালয় বানিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। কী ভাবে দিন কাটাই, সে আমরাই জানি।’’

উন্নয়নের মডেল নিছকই কথার কথা এই সব গ্রামে

গাঁধীনগর, অমদাবাদ, বডোদরা, সুরত, রাজকোট, ভাবনগর, জামনগর, জুনাগড়— শহুরে এলাকায় উন্নয়নের ছাপ রয়েছে, সে কথা ঠিক। গোটা রাজ্য জুড়ে সড়ক এবং অন্যান্য পরিকাঠামোর উন্নয়নও হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজরাতের এই উন্নয়ন মূলত ধনী শ্রেণির উন্নয়ন। দারিদ্র ঘোচানো যায়নি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন খুব বদলে দেওয়া যায়নি।

অতএব ক্ষোভ সঙ্গী করেই কিন্তু ভোট দিয়েছে গুজরাতের বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কংগ্রেস। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের কোনও যুক্তিই তেমন ধোপে টেকেনি ভোটের ময়দানে। কিন্তু সব ইস্যুর বিপরীতে নিজেকে স্থাপন করলেন নরেন্দ্র মোদী। গুজরাতে মোদীর যে ভাবমূর্তি এখনও রয়েছে, তার ভিত্তিতেই নির্বাচন জিতে নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। ফলাফলই বলে দেবে, গুজরাতের মানুষ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে তাকিয়ে ভোট দিলেন। ক্ষোভের দিকে? নাকি মোদীর দিকে?

ছবি: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়।

Gujarat Gujarat Assembly Election 2017 BJP Congress Gujarat Model Development Social sector Child Mortality Poverty গুজরাত গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন ২০১৭ Video
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy