Advertisement
০১ মে ২০২৪

নামছে জলস্তর, বড় বিপদের মুখে ভারত

এ বার কি স্পেনের মতো জাহাজে করে জল আনতে হবে ভারতে? কিংবা জলের অভাবে সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হবে ভারতে। ভাবছেন অলীক কল্পনা! না, মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার ‘গ্রাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট (গ্রেস)’ উপগ্রহের তথ্য কিন্তু তেমনই বলছে।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৫ ০১:০৭
Share: Save:

এ বার কি স্পেনের মতো জাহাজে করে জল আনতে হবে ভারতে? কিংবা জলের অভাবে সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হবে ভারতে। ভাবছেন অলীক কল্পনা! না, মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার ‘গ্রাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট (গ্রেস)’ উপগ্রহের তথ্য কিন্তু তেমনই বলছে।

কী দেখেছে গ্রেস?

গ্রেস পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন হিসেব করে ভূর্গস্ত জলস্তরের পরিবর্তন জানাতে পারে। নাসা জানাচ্ছে, ভারতের ক্ষেত্রে গ্রেসের ফলাফল সবচেয়ে উদ্বেগজনক। গ্রেস দেখাচ্ছে, উত্তর ভারতে ভূগর্ভস্থ জলস্তরে হ্রাসের হার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। হরিয়ানা, পঞ্জাব, রাজস্থান আর দিল্লিতে ২০০২ থেকে ২০০৮-এর মধ্যেই ১০৮ কিউবিক কিলোমিটার জল হ্রাস পেয়েছে। মূল কারণ, সেচে গর্ভস্থ জলের ব্যবহার। পাম্পে দেদার জল তুলে ফসল তো ফলছে, কিন্তু চরম সঙ্কটে পড়তে চলেছেন ১১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ। শুধু জলসঙ্কট নয়, কৃষি, শিল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন— প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রেই।

ভাবছেন কী ভাবে?

২০১২-এর জুলাইয়ের কথা মনে আছে? গ্রিড বিপর্যয়ে কী ভাবে ভারতের বড় অংশ নিঃষ্প্রদীপ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতে, খরার জন্যই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির উৎপাদন কমে গিয়েই এই বিপর্যয়। ভাবছেন বৃথা ভয় দেখাচ্ছি! তবে চলুন একটু বিশ্বভ্রমণ করা যাক।

প্রথমে অস্ট্রেলিয়া। ক্যাঙারুর দেশে শুধু ক্রিকেটই দেখলেন। জানেন কি, ১৯৯৫-২০০৯ পর্যন্ত ও দেশে খরা চলেছিল? জলধারে জল হুহু করে কমতে থাকে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন মার খায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় মেলবোর্ন, সিডনি, পার্থে প্রশাসন ‘ডিস্যালিটেশন প্ল্যান্ট’ তৈরি করে। অন্য বেশ কয়েকটি শহর ‘গ্রে ওয়াটার রিসাইক্লিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ চালায়। অস্ট্রেলীয় সরকার খরা সামলাতে ৪৫০ কোটি ডলার ব্যয় করে। ভাবুন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ কত কষ্টে সামলেছে! আর ভারত হলে?

এ বার চলুন ইউরোপে।

আগেই বলেছিলাম স্পেনের কথা। সেখানে মেসি, নেইমার, সুয়ারেজের বার্সেলোনার অবস্থা কিন্তু বেশ করুণ। ২০০৮ ক্যাটালোনিয়া প্রদেশের এই অঞ্চলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ফ্রান্স থেকে জাহাজে করে জল আনতে হয়। স্পেনে ৭০ শতাংশ জলের ব্যবহার হয় কৃষিক্ষেত্রে। অপচয়ী সেচব্যবস্থা আর জলের উপরে অতিরিক্তি নির্ভরশীল শস্যের জন্যই এই পরিস্থিতি বলে অনেকে মনে করছেন। আবার অনেকের মতে জল অত্যন্ত সস্তা হওয়ায় অপচয় রোধ করা যাচ্ছে না। যাকে বলে সস্তার শাস্তি। পাশাপাশি এই অঞ্চলে জলের পরিকাঠামোর পিছনে বিশেষ বিনিয়োগও হয়নি।

লাতিন আমেরিকা কী অবস্থায়?

আপনাদের নিয়ে যাই ফুটবলের মক্কা ব্রাজিলে। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রাজিলের সাও পাওলো, রিও ডি জেনিরো, বেল হরিজন্তের নাম তো আগের বছরই খবর দেখে দেখে, পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নে ভেবেছেন এক বার পারলে পেলে, জিকো, রোনাল্ডো, নেইমারে দেশে ঘুরে আসবেন। দাঁড়ান, ওই সব শহরে জলসঙ্কটের কথা জানেন কি? গত ৮৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। জলাধারগুলিতে জলস্তর দ্রুত কমছে। রয়েছে জলদূষণের সমস্যাও। প্রায় চার কোটি মানুষ সঙ্কটে। সে দেশের নেতার আমাদেরই মতো। তাঁদের রাজনৈতিক দূরদর্শীতার অভাবে সঙ্কট আরও তীব্র হচ্ছে।

আসুন ড্রাগনের দেশে যাই। চিনের আর্থিক বৃদ্ধিতে আমাদের চোখ টাটায়। বেজিং, সাংহাই-এর মতো শহর এখন নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিসের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কিন্তু এই উন্নয়নের জোয়ারে টান পড়েছে জলের ভাণ্ডারে। বিশেষ সঙ্কটে চিনের উত্তর ভাগ। শিল্প, বিদ্যুৎ তৈরি, শহরের জলের চাহিদা মেটাতেই নাভিশ্বাস উঠছে। এ ভাবে চললে চিনের জলসঙ্কট দ্রুত বড় আকার নেবে। তবে আশার কথা চিনের প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে আছে বিষয়টি। শুরু হয়েছে ‘থ্রি রেড লাইনস’ প্রকল্প। সেখানে জলের উপযুক্ত ব্যবহার এবং অপচয় রোধের নানা পরিকল্পনা আছে। তবে প্রকল্পটি আদৌ কতটা কাজ দেবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বার এশিয়ার অন্য দিক সিরিয়ায় চোখ ফেরান। ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর দৌরাত্ম্যে প্রায় প্রতি দিনই এই অঞ্চল সংবাদ শিরোনামে আসছে। টাইগ্রিস, ইউফ্রেতিস লালিত সভ্যতার পীঠস্থান মেসোপটেমিয়া জলসঙ্কট তীব্র। ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমার হারে সিরিয়া পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথমে কিন্তু মোদের ভারত। অনেকের মতে এই অঞ্চলের অস্থিরতার পিছনে জলাভাবও বড় কারণ। এর জন্য কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয়। বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবন। শহরের পরে শহর ছেড়ে বাসিন্দারা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন, উদ্বাস্তু হয়ে। ভিড় বাড়ছে অন্য দেশে।

আর মার্কিনমুলুক? সর্বশক্তিমান দেশও রেহাই পায়নি। গত চার বছর ধরে ক্যালিফোর্নিয়ায় খরা চলছে। হলিউডে চোখ ধাঁধালেও জেনে রাখুন ওই প্রদেশের গভর্নর জেরি ব্রাউন জলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার আদেশ দিয়েছেন। ঠেলায় পড়ে কৃষকরাও জলের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হয়েছেন। দ্রুত পরিকল্পনা না করতে পারলে ভবিষ্যতে ‘গডস ওন কান্ট্রি’তে সঙ্কট আরও গভীর হতে চলেছে।

জেমস বন্ডের ছবি দেখেন? ‘কোয়ান্টাম অফ সোলাস’-এর ভিলেন দমিনিক গ্রিনকে মনে আছে? কী ভাবে নদীর জলকে আটকে রেখে সঙ্কট তৈরি করেছিল সে। আর তা নিয়েই কত লড়াই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি নয়, তেল নয়, মাটির বুকের ভিতর বন্দি জলের জন্যই হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে নানা প্রকল্প নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেছেন ‘জল ধর, জল ভর’ প্রকল্প। দু’টিই আশার কথা। কিন্তু সরকারই প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, বেশ কিছুটা নির্ভর করেছে মানুষের সচেতনতার উপরে। বড় কিছু নয়, প্রতি দিন জলের অপচয় কমাতে পারলে কাজ বেশ কিছুটা এগিয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞদের মত। বিন্দু বিন্দু জমেই তো সিন্ধু।

এই সংক্রান্ত আরও খবর...

জলস্তরের উপরে নজরদারি নেই, শুধু খরচের অনুমোদন ঢালাও

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE