Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মার্কিন দখল রুখতে পথে, চিন সাগর নিয়ে নীরব বাম

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর অধ্যাপক সৌম্যজিৎ রায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘আসলে সিপিএম এখনও চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক মনে করে।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৮
Share: Save:

সেই বাষট্টির চিন-যুদ্ধ থেকে শুরু। বেজিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এ দেশের কমিউনিস্টরা ‘চিনের দালাল’ আখ্যা পেয়েছিলেন। তার পরে পার্টি ভাগ হয়েছে। গঙ্গা-হোয়াংহো দিয়ে অনেক জল বয়েছে। কিন্তু এখনও চিনের নামে সিপিএম নেতাদের বুকের ‘বাম’ দিকে চিনচিনে ব্যথাটা রয়েই গেল।

তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক বলে স্লোগান তুললেও তাঁরা চিনের ‘সাম্রাজ্যবাদ’ নিয়ে মুখ খোলেন না। সে রাষ্ট্রপুঞ্জ যতই চিনের বিরুদ্ধে রায় দিক না কেন।

দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের দখলদারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জে নালিশ জানিয়েছিল ফিলিপিন্স। ভিয়েতনামও ওই এলাকায় চিনের খবরদারির শিকার। আঘাত লেগেছে ভারতের স্বার্থেও। দু’দিন আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে, দক্ষিণ চিন সাগরের জলসীমা ও তার সম্পদে বেজিংয়ের কোনও অধিকার নেই। সিপিএম নেতাদের নীরব সমর্থন তবু চিনের দিকেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বিষয়ে যাঁরা বিবৃতি দেন, সেই সিপিএমের নেতারা এ বিষয়ে চুপচাপ। প্রশ্ন করা হলে দলের নেতা নীলোৎপল বসু বলছেন, ‘‘এ তো চিনের সঙ্গে ফিলিপিন্স বা ভিয়েতনামের এলাকা নিয়ে বিবাদ। তারা আলোচনা করে মিটিয়ে নেবে। আমেরিকা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছে। ভারতের নাক গলানোর দরকার কী!’’ একে চিনের ‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন’ বলেও মানতে নারাজ সিপিএম নেতৃত্ব।

এনএসজি-তে ভারতের প্রবেশপথে বাধা হয়েছিল চিন। সেখানেও সিপিএম ছিল বেজিংয়ের পাশে। প্রকাশ কারাট দলীয় মুখপত্রে লিখেছিলেন, ‘‘মোদী সরকার শুধু চিনকে দোষ দিয়ে ভুল করছে। আরও ন’টি দেশ একই আপত্তি তুলেছিল।’’ কারাটের যুক্তি, আমেরিকা চিনকে দাবিয়ে রাখতে চায়। তাতে মদত দিয়ে চিনকে চটিয়ে রাখছে মোদী সরকার। তার পরেও চিন পাশে থাকবে, আশা করাটা নিছকই দম্ভ।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর অধ্যাপক সৌম্যজিৎ রায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘আসলে সিপিএম এখনও চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক মনে করে। নেতারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, হংকং বা তিব্বতে চিনের আগ্রাসন নিয়ে মুখ খোলেন না। সিপিএম তাই চিনের পাশে দাঁড়াবে না তো কোথায় দাঁড়াবে!’’

১৯৬৪-তে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার পিছনেও অন্যতম প্রধান কারণ ছিল মস্কো বনাম চিনের বিবাদ। অর্ধশতক কেটে গিয়েছে। চিনে পার্টির চরিত্র আমূল বদলেছে। অর্থনৈতিক দর্শন বদলেছে। কিন্তু চিনের প্রতি আনুগত্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি সিপিএম নেতারা। চিন অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করলেও সিপিএম তাতে ভুল দেখে না। যুক্তি দেয়, কেন্দ্রে শাসক দল চিনকে নিশানা করে জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলছে। সিপিএমের সাধারণ

সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির যুক্তি, ‘‘নয়াদিল্লির উচিত প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ানো। ‘পুবে তাকাও নীতি’ মেনে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করা এবং আমেরিকার চাপে চিনের সঙ্গে বিবাদে না গিয়ে মীমাংসার রাস্তা খোঁজা।’’

চিন নিয়ে সিপিএমের অন্দরমহলেও অবশ্য বিবাদ কম নয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে কেন্দ্রীয় নেতারা অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তিনি যেন চিনকে একটি বিষয়ে সাহায্য করতে মনমোহন সরকারের কাছে দরবার করেন। বুদ্ধদেব তা খারিজ করে দেন। আবার বুদ্ধদেবের শিল্পায়ন নীতিকে দেং জিয়াও পিং-মডেলের অনুকরণ হিসেবে দেখা হতো। চিনে একদলীয় শাসনব্যবস্থায় কৃষিজমি দখল করে যে ভাবে শিল্পায়ন সম্ভব, এ দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে তা সম্ভব কি না, তা নিয়ে জোর বিতর্ক হয়েছিল। বাম সরকারের পতনের পর কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে এ নিয়ে পৃথক মতাদর্শগত দলিল তৈরি হয়। কারাট-শিবির শিল্পের নামে কৃষকের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জমি নেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিল। উল্টো দিকে ছিলেন ইয়েচুরি-বুদ্ধদেবরা।

চুলচেরা বিচারের পরেও চিন নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া যায়নি। মতাদর্শগত দলিলে চিনের প্রসঙ্গে ২০টি অনুচ্ছেদের ১০টিতে ছিল তাদের গুণগান। ১০টিতে সমালোচনা। ইয়েচুরি বলেছিলেন, চিন যত দিন নিজেদের ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলবে, তত দিন সিপিএম পাশে থাকবে। তবে চিনে আর্থিক বৃদ্ধির পাশাপাশি অসাম্য, বেকারত্ব, দুর্নীতিও বাড়ছে। চিন কী ভাবে এর মোকাবিলা করে, দেখতে হবে।

এখনও সেই ‘ইহাও হয়, উহাও হয়’ অবস্থানেই রয়েছে সিপিএম। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এম জি এস নারায়ণন বলেন, ‘‘আমার মনে হয় সিপিএম নেতারা বিভ্রান্ত। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে চিনের প্রতি ওঁদের আনুগত্য সীমাহীন। ফলে অর্থনীতি বা বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ভুল দেখলেও চিনের বিরোধিতা করতে পারছেন না তাঁরা। মনস্থির করা মুশকিল হচ্ছে।’’

এই দোলাচলকেই নিশানা করছে বিজেপি। দলের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সিংহের যুক্তি, ‘‘সিপিএমের টিকি বাঁধা রয়েছে বেজিংয়ে। জাতীয়তাবাদের থেকেও সিপিএমের কাছে মতাদর্শই বড়। কিন্তু সেই মতাদর্শের আর প্রাসঙ্গিকতা নেই বলেই মাত্র দু’তিনটি রাজ্যে সিপিএম টিকে রয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Left South china sea
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE