Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
তেতো দাওয়াইয়ের দিন

ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে হবে মোদীকে

পঁচিশ বছরে এই প্রথম লন্ডনে টেনিস খেলা ছেড়ে জুন-জুলাই মাসের গরমে দিল্লিতে দিন কাটাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কৃচ্ছ্রসাধন। কিন্তু দেশের নাগরিকদের কি তিনি কৃচ্ছ্রসাধন করাতে পারবেন? গত দশ বছরে কাণ্ডজ্ঞানহীন জনতোষণ আর ভয়াবহ নীতিপঙ্গুতায় দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এহেন পটভূমিতে তিরিশ বছর পর ভারতের মানুষ দিল্লির মসনদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে এক প্রধানমন্ত্রীকে বসিয়েছেন। সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধান সেনাপতি অরুণ জেটলি আগামিকাল নতুন সরকারের প্রথম বাজেট পেশ করতে চলেছেন।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০৪:৫৩
Share: Save:

পঁচিশ বছরে এই প্রথম লন্ডনে টেনিস খেলা ছেড়ে জুন-জুলাই মাসের গরমে দিল্লিতে দিন কাটাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কৃচ্ছ্রসাধন। কিন্তু দেশের নাগরিকদের কি তিনি কৃচ্ছ্রসাধন করাতে পারবেন?

গত দশ বছরে কাণ্ডজ্ঞানহীন জনতোষণ আর ভয়াবহ নীতিপঙ্গুতায় দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এহেন পটভূমিতে তিরিশ বছর পর ভারতের মানুষ দিল্লির মসনদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে এক প্রধানমন্ত্রীকে বসিয়েছেন। সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধান সেনাপতি অরুণ জেটলি আগামিকাল নতুন সরকারের প্রথম বাজেট পেশ করতে চলেছেন।

প্রশ্ন একটাই। এই প্রতিকূল অর্থনৈতিক আবহে মোদী তাঁর অর্থমন্ত্রীর হাত দিয়ে রোগীকে তেতো ওষুধ গেলাতে সক্ষম হবেন কি? প্রধানমন্ত্রী আনন্দবাজারকে বলেন, “রোগী যদি ডায়াবেটিক হয়, তা হলে আর যাই হোক, তাঁকে রসগোল্লা খাওয়ার পরামর্শ কেউ নিশ্চয়ই দেবেন না।” আবার মোদী এ-ও বলেন, “সংস্কার মানে জনগণ-বিরোধিতা নয়। অর্থনীতির কঠোর বাস্তব মেনে দাওয়াই দেওয়াটা জনবিরোধী কেন হতে যাবে?”

এ কথায় একটা সঙ্কেত স্পষ্ট। রেল বাজেটের মতো সাধারণ বাজেটেরও একই রাজনৈতিক অভিমুখ দিতে চাইবে কঠোর প্রশাসক বলে পরিচিত নরেন্দ্র মোদীর সরকার। জেটলিও বলেছেন, “কেউ কেউ বলছিলেন, সরকার সবে ক্ষমতায় এসেছে। তার কি জনপ্রিয়তা হারানো উচিত! বিশেষ করে কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন যখন আসন্ন। কিন্তু আমার মনে হয়, কড়া ব্যবস্থা গোড়াতেই নিয়ে নেওয়া ভাল। আর্থিক সংস্কারের মতাদর্শে কোনও রবিবার নেই।”

প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী যা-ই বলুন, রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়া কিন্তু সহজ নয়। এমন তো নয় যে, মনমোহন সিংহের সরকার সংস্কার বিরোধী ছিল। ইউপিএ-র প্রথম অধ্যায়ে আয়বৃদ্ধির হার শতকরা আট ভাগ পর্যন্ত গিয়েছিল, এ-ও তো সত্য। কিন্তু ইউপিএ-র দ্বিতীয় অধ্যায়ে মাথাচাড়া দিল নীতিপঙ্গুত্ব। ফলে পরিবেশ মন্ত্রক থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সর্বত্র আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের বাঁধনে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠল। বাড়ল জিনিসপত্রের দাম। অমিল হল বিদেশি লগ্নি। অন্য দিকে, একশো দিনের কাজ থেকে খাদ্য নিরাপত্তার মতো সামাজিক প্রকল্পের জন্য বিপুল খরচ বাড়ল সরকারের। যার নিট ফল, আর্থিক বৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়ল ৫%-এরও নীচে।

এই পরিস্থিতিতে আর্থিক স্বাস্থ্য চাঙ্গা করার জন্য ভুলতে হবে সস্তা হাততালি কুড়নোর আকর্ষণ। দেখাতে হবে রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষে সেটা করা সম্ভব বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়। তাঁর কথায়, “এই সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত। তাই তার কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি।” ১৯৮৪ সালে রাজীব গাঁধী এই সুযোগ পেয়েছিলেন। আর্থিক সংস্কারের কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু বফর্স ও নানা দুর্নীতি তাঁর কর্তৃত্ব দুর্বল করে দেয়। ফলে শেষ রক্ষা হয়নি।

এর পর ১৯৯১ সালে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নরসিংহ রাও এক প্রকার বাধ্যই হয়েছিলেন আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটতে। সে দিন তাঁর সেনাপতি ছিলেন মনমোহন সিংহই। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে, বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে স্তিমিত হয়ে পড়ে আর্থিক সংস্কার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আজ যদি সেই বেলাইন গাড়িতে গতি ফেরাতে চান মোদী, তা হলে গোড়াতেই ভর্তুকি সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে হবে তাঁকে।

সেই লক্ষ্যে ক্ষমতায় এসেই রেলের ভাড়া বাড়িয়েছেন মোদী। কিন্তু এখনও অনেক পথ চলা বাকি। অনেক কঠোর, অ-জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত এই সরকারকে নিতে হবে। চিদম্বরমের অন্তর্বর্তী বাজেটে সারে ভর্তুকি তোলার ব্যাপারে যতটা দিগনির্দেশ ছিল, তার থেকে দশ গুণ বেশি করতে হবে। যদিও সেটা মোটেই সহজ কাজ নয়। কারণ, এর সঙ্গে প্রভাবশালী বড় চাষিরা যুক্ত। এমনকী, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন, যেগুলি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে ভর্তুকি তোলাও কঠিন।

খরচ কমানোর পাশাপাশি আয়ও বাড়াতে হবে সরকারকে। তবে অর্থ মন্ত্রক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, খুব বেশি কর চাপিয়ে রাজস্ব সংগ্রহের পথে হাঁটতে চাইছেন না জেটলি। তিনি বিলগ্নিকরণের উপরে জোর দিতে পারেন। ২০১৩-’১৪ সালে যে মনমোহন সরকার বিলগ্নিকরণ থেকে মাত্র ২৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে সক্ষম হয়েছিল। কেউ কেউ বলছেন, জেটলিকে এক লক্ষ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করতে হবে। যদিও সেটা খুব বাস্তবসম্মত নয় বলেই অনেকের মত।

এই অবস্থায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বহু ক্ষেত্রে সংস্কার করা দরকার বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। যেমন, সংশোধিত জমি অধিগ্রহণ আইন পাল্টে তাকে আরও বেশি শিল্প সহায়ক করে তুলতে হবে। সহজ করতে হবে শ্রম আইন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে আরও বেশি করে খুলে দিতে হবে বাজারি লগ্নির দরজা। বদলাতে হবে পণ্য পরিষেবা কর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পথ সুগম করতে হবে।

শরিক আঞ্চলিক দলগুলির চাপে এর কোনওটাই করে উঠতে পারেনি মনমোহন সিংহের সরকার। অর্থনীতিবিদ ওঙ্কার গোস্বামী বলছেন, “এ বার একদলীয় সরকার। শরিকি সমস্যা না-থাকায় সংস্কার করাটা এই সরকারের পক্ষে সহজ। রেল বাজেটে তেমন দিশাই দেখা গিয়েছে।”

মনমোহন সিংহ ভারতে আর্থিক সংস্কারের জনক হলেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সনিয়া গাঁধীর চাপে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে আরও বেশি বেশি করে সামাজিক প্রকল্প গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সনিয়া আসলে রাজীব নয়, আদর্শ করেছিলেন ইন্দিরা গাঁধীকে। তাঁর জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ গত দশ বছর ধরে সামাজিক ন্যায় এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়াজ তুলেছে। ফলে মনমোহন সরকার যত না বেশি শিল্পোৎপাদন তথা বৃদ্ধির দিকে জোর দিয়েছিল, সনিয়া-রাহুল তার চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন সামাজিক বণ্টন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়।

অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদরা এই সামাজিক ক্ষমতায়নের পক্ষে সরব হলেও অমর্ত্য-পন্থী অর্থনীতিবিদরাই অনেকে বলেছেন যে, ইউপিএ সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলি প্রান্তিক অন্ত্যজ মানুষের কাছে বিশেষ পৌঁছয়নি।

এই প্রকল্পগুলি বাস্তবে তেলা মাথায় তেল দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী এবং অরবিন্দ পানাগড়িয়ার মতে, এ ভাবে মধ্যবিত্তদের ভর্তুকি না দিয়ে বরং বৃদ্ধি এবং উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া উচিত। এই পথ মোটেই জনবিরোধী নয়। এই বৃদ্ধি কর্মসংস্থানের সুযোগ এনে দেবে। যা দেশে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে।

মোদীও বলছেন, আর্থিক ও সামাজিক অভিমুখ রচনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক ভ্রান্তমানসিকতায় তিনি বদল আনতে চান। শুধু ভর্তুকি দিলেই গরিব মানুষের উন্নতি করা যায় না। গোটা দেশের বৃদ্ধির ইঞ্জিনকে সচল করলে গরিব মানুষেরও উপকার হবে। শিল্পের উন্নয়ন আর গরিব মানুষের উন্নয়ন এই দুটোর মধ্যে যাঁরা সংঘাত রচনা করতে চান, তিনি তাঁদের পক্ষে নন। বরং সমাজকে টুকরো টুকরো না করে এক সামগ্রিক আর্থিক বিকাশের পথে এগোতে হবে। এই বক্তব্য খুব স্পষ্ট ভাবেই ভগবতী-পানাগড়িয়ার মতের অনুসারী।

মোদী যা বলছেন, তাতে অনেকের ধারণা, এই সরকার মার্কিন রিপাবলিকান বা ব্রিটিশ টোরি দলের মতো এক দক্ষিণপন্থী আধুনিক পুঁজিবাদী পথে হাঁটতে চাইছে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান কাঠামোয় সেটা কতটা সম্ভব সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যদি সত্যি সত্যি সনিয়ার সামাজিক প্রকল্পগুলি বাতিল করে দেওয়ার হিম্মত তাঁর থাকত, তা হলে তিনি এই প্রকল্পগুলির দায়দায়িত্ব রাজ্য সরকারের হাতে তুলে দিতে চাইতেন না। অনেকের ধারণা, প্রকাশ্যে এই প্রকল্পগুলিকে সরাসরি বাতিল করে রাজনৈতিক শোরগোল তোলার সুযোগ না-দিয়ে মোদী ধীরে ধীরে সেগুলিকে বিনাশের পথে নিয়ে যাবেন।

নরসিংহ রাওয়ের আমলে ‘চুপিসারে সংস্কার’-এর ধারণা জনপ্রিয় হয়েছিল। ইতিহাস কিন্তু বলে, রাও জমানার প্রকৃত সংস্কার প্রথম দফাতেই সারা হয়েছিল, এবং তা মোটেই চুপিসারে হয়নি। প্রথম রাতে বেড়াল মারার গল্পটা মোদী, জেটলিদের জানা আছে নিশ্চয়ই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

modi bold decision general budget
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE