Advertisement
E-Paper

হাতে-গরম চিকিৎসক: চিত্রশিল্পী হঠাৎ করেই যেন নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায়!

তা হলে এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষা এবং রোগী পরিষেবার খুঁটিনাটি কারা দেখবে?

সাত্যকি হালদার

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:৩৭
অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের প্রতিবাদ। কলকাতায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের প্রতিবাদ। কলকাতায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন বিলের নানা ধারা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিরোধীদের তো বটেই, সরকার পক্ষের ভিতরেও রয়েছে নানা প্রশ্ন। আর সে কারণেই বিলটিকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ফলে, চলতি অধিবেশনে বিলটি আসার সম্ভাবনা আর রইল না। কিন্তু স্পিকারের স্পষ্ট নির্দেশ, বাজেট অধিবেশনের আগেই কমিটিকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।

সংসদে সরকার এবং বিরোধী পক্ষের বাদানুবাদ তো অনেক পরের বিষয়। তার আগেই ওই খসড়া বিলকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে ঝড় উঠেছে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক মহলে। খসড়া বিলের প্রতিবাদে গত কাল অর্থাৎ মঙ্গলবার সারা দেশে প্রায় তিন লক্ষ চিকিৎসক সকাল ছ’টা থেকে সন্ধে ছ’টা জরুরি বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা অবশ্য চিকিৎসকদের এই প্রতিবাদের কোনও কারণ খুঁজে পাননি। বরং তিনি জানিয়েছেন, বিলটি পাশ হলে আদতে তা চিকিৎসা পেশার সপক্ষেই যাবে। যদিও কী ভাবে বিষয়টি চিকিৎসা পেশার সহায়ক হবে তার উল্লেখ নেই মন্ত্রীর কথায়। এমসিআই-এর নানা রকম অনিয়মের কথা বিলটি প্রসঙ্গে বলা হলেও এনএমসি কী ভাবে শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের দিকগুলি সামলাবে তারও উল্লেখ করেননি মন্ত্রী।

ওই বিলে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের সর্ব-ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (এমসিআই)-কে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তা হলে এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষা এবং রোগী পরিষেবার খুঁটিনাটি কারা দেখবে? খসড়া বিল বলছে, ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন’ (এনএমসি)। স্বাভাবিক ভাবেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে মেডিক্যাল কাউন্সিল ও তার শাখাগুলি। এমসিআই-কে সরিয়ে নতুন কমিশনের যে প্রস্তাবনা করা হয়েছে, তাতে চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়কে আরও বেশি করে আমলা নির্ভর একটি বিধির মধ্যে আনার চেষ্টা দেখা গিয়েছে।

বিলটিতে চিকিৎসক নন এমন ব্যক্তিদের কমিশনের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বসানোর সুপারিশ রয়েছে। তাই আমার মতো বহু চিকিৎসকই সন্দেহ প্রকাশ করছেন এই কমিশনের শেষাবধি কার্যকারিতা নিয়ে। ডাক্তারি শিক্ষা-ব্যবস্থা, গবেষণা এবং চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের যে পেশাগত ও মানবিক দিক তা চিকিৎসক নন এমন ব্যক্তি এবং আমলাতন্ত্রের আয়ত্তাধীন হলে আখেরে সাধারণ মানুষ পরিষেবার আরও প্রান্তিকতায় পৌঁছে যেতে পারেন। বিষয়টি চিকিৎসক হিসাবে নয়, সংবেদী মানুষ হিসাবেও তো ভাবাচ্ছে আমাকে।

আরও পড়ুন
স্থায়ী কমিটিতে গেল মেডিক্যাল কমিশন বিল

কিন্তু এ সব প্রশাসনিক পদ দখল, সমস্ত বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জাহির (সিনেমা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও স্বাস্থ্য), এই বিষয়গুলির পাশাপাশি কমিশন-বিলের ৪৯ নম্বর ধারাটি সম্ভবত সব চাইতে বেশি মাথাব্যথার কারণ। এই ধারাটি সব চাইতে ক্ষতিকর। এবং বিলের উত্থাপকদের হটকারি ভাবনা ও চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রকৃত উদাহরণ হিসাবেই মনে হচ্ছে।

এ কথা ঠিক যে ভারতবর্ষে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বেশ অপ্রতুল। এবং সাম্প্রতিক সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, পৃথিবীর যে দেশগুলিতে রোগী-প্রতি সব চাইতে কম সময় ডাক্তাররা দিতে পারেন, সেই তালিকায় আমাদের দেশ প্রথম তিনে রয়েছে। সাধারণ চিকিৎসক থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সব ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের রোগীরা নুন আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখেন পান্তা নিঃশেষ। সরকারি ব্যবস্থায় তাঁদের এক মিনিটের ভেতর রোগের বিবরণ বলে, সান্ত্বনা পাওয়ার মতো পরীক্ষা করিয়ে, ওষুধের প্রেসক্রিপশন হাতে বাইরের দরজার কাছে চলে যেতে হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একটা দীর্ঘ সময় এমন পরিস্থিতি আমি প্রায় প্রতি দিন দেখেছি। আর বেসরকারি পরিষেবার দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছনোর ক্ষমতা শতকরা ৯৩ ভাগের তো নেই। অতঃপর কী বা করা!

আর সে কারণেই নাকি বিচক্ষণ ৪৯ ধারার অবতারণা! যে ধারায় পরিষ্কার ভাবে বলা হল, চিকিৎসক সংকট মেটাতে চিকিৎসার যে সব স্বল্প প্রচলিত ধারা, যথা আয়ুর্বেদ, যোগা, ইউনানি, সিদ্ধা এবং হোমিওপ্যাথি (একত্রে ‘আয়ুস’) সে সব ধারায় যাঁরা চিকিৎসা করছেন তাঁদের অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লেখা ও সার্জারি-সহ অন্যান্য কাজের উপযুক্ত করে তোলা হবে। এ ব্যাপারে অতি সংক্ষিপ্ত ‘ব্রিজ-কোর্স’-এর কথাও বলা হয়েছে নতুন ধারায়— সংক্ষিপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় হাতে-গরম চিকিৎসককুল পাওয়া যাবে স্বল্পমূল্যে ও সুলভে। শুনে আশ্চর্য লাগছে?

আমার মতো যাঁরা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাক্রমে রোগীদের নিদান দিয়ে আসছেন, তাঁরা কেউ কেউ হয়তো সামাজিক এক্সক্লুসিভনেস ‘লঘু’ হওয়ার চিন্তা করছেন। কিন্তু, আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানি, কম প্রচলিত পদ্ধতির যে চিকিৎসকেরা তাদের বিধি অনুযায়ী মানুষকে চিকিৎসা দেন, তাঁরাও বিব্রত হচ্ছেন এই তুঘলকি প্রস্তাবনায়। চিত্রশিল্পীকে হঠাৎ নৃত্যশিল্পীর ভূমিকা নিতে হলে তাঁর তো বিড়ম্বনা বাড়বেই। তাঁর সামাজিক মর্যাদাতেও আঘাত লাগার কথা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ভাবতে শুরু করবেন, নতুন তেমন একটা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক হলে তিনি কার কাছে যাবেন শেষ পর্যন্ত? কোন বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে নিজের উপসর্গের কথাটি বলবেন। ‘ব্রিজ-কোর্স’ তাঁকে এক লহমায় পৃথিবীর সাঁকোর ও পারে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করবে না তো! আমিও নিজের চিকিৎসক পরিচয়টাকে সরিয়ে দিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখেছি, একই প্রশ্ন আমার মধ্যেও তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন
মেডিক্যাল কমিশন বিল: প্রতিবাদে ব্যাহত চিকিৎসা পরিষেবা

আসলে, সমস্ত পেশার ক্ষেত্রেই অনুশীলন ও নির্দেশিত সময়ের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে আমার মনে হয়। বিশেষজ্ঞ তৈরির ক্ষেত্রে অনুশীলন ও সময়ের যোগাযোগ আরও অনেক গভীর। এক জন প্রকৌশলী, অভিনেতা, সাংবাদিক বা এক জন বাস ড্রাইভারকে জীবনের এক পর্যায়ে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়। জীবনের কিছু কাল-পর্ব ব্যয় হয় নিজেকে পেশার উপযুক্ত করে তুলতে। সেই পর্বের আর যা হোক কোনও ‘শর্ট কাট’ হয় না। কোনও ভাবেই সেই সময় বা পরিশ্রমকে সংক্ষেপিত করা যায় না। ঠিক যেমন হঠাৎ করে উল্লম্ফনে এক দক্ষতা থেকে আর এক দক্ষতায় স্থানান্তরিত হওয়া যায় না, তেমনি রাজাও চাইলে প্রজাকে রাতারাতি মন্ত্রী বা মন্ত্রীকে সেনাপতি বানিয়ে দিতে পারেন না। কেন জানেন? মন্ত্রীকে সেনাপতি বানালে তাৎক্ষণিক শূন্য পদ পূরণ হয় হয়তো, তবে অচিরে যে যুদ্ধটি আসে তাতে পরাজয় সুনিশ্চিত হয়।

ওই বিলের আর একটা অংশে বেসরকারি হাসপাতালে ম্যানেজমেন্ট কোটা ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। এতে মেডিক্যাল শিক্ষার খরচও বাড়বে। কারণ, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ওই ৬০ শতাংশ আসনের ফি ঠিক করবে প্রতিষ্ঠানই। ফলে গরিব, মেধাবী পড়ুয়াদের জন্য ডাক্তারি পড়া সাধ্যের বাইরে চলে যেতে পারে।

আমার মনে হয়, এ ভাবে প্রশাসনিক দখলদারি, সর্বত্র অনুগামী প্রতিষ্ঠার বদলে দেশে চিকিৎসক ঘাটতি মেটাতে সরকার বরং আরও ডাক্তারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানোর দিকে মন দিন। পরিকাঠামো ঠিক রেখে এমবিবিএস এবং বিশেষজ্ঞ কোর্সে আসন সংখ্যা স্তরে স্তরে বাড়িয়ে তোলা হোক। ডাক্তারি পড়ার সুযোগটি ক্রমশ যে ইংরাজি জানা এবং কর্পোরেট টিউটোরিয়ালে পড়াতে পারা পরিবারগুলির কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে দেশ জুড়ে ভাবনা ও বিতর্কের আবহই বা তৈরি করা হবে না কেন? কারণ, এই পুরো পদ্ধতিই শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য। তার কত কাছে পরিষেবা পৌঁছয়, সেটাই তো সরকারের প্রধান চেষ্টা হওয়া উচিত।

রাজনীতি বা সরকারের কেষ্টবিষ্টুরা সেটা ভেবে দেখছেন কি?

National Medical Commission Bill Medical Council of India IMA ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy